আল কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খলিলুর রহমান মুমিন
খায়রুন প্রকাশনী
প্রকাশকের কথা
আল-কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য গ্রন্থটি আধুনিক প্রকাশনী ১৯৯৭ সালে প্রথম এবং ২০০১ সালে এর ২য় সংস্করণ প্রকাশ করে। মাস তিনেক আগে অনুবাদক সাহেব আমাদের কাছে গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য নিয়ে আসে। অনুবাদকের কাছ থেকে অনুবাদস্বত্ব নিয়ে আমরা এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করছি।
আল্লাহ অহী এ কুরআনকে অনুপম রচনাশৈলীর মাধ্যমে উপস্থাপনের জন্য লেখক যেমন মহান আল্লাহর কাছে পুরষ্কৃক হবেন। তেমনি বর্তমান মুসলিম জাতির কাছেও অমর হয়ে রইলেন। সাথে সাথে এর অনুবাদকও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে অপূর্ব এ গ্রন্থটি উপহার দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতার জালে আবদ্ধ হয়ে রইলেন।
খায়রুন প্রকাশনী এ গ্রন্থটি উপহার দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতার জালে আবদ্ধ হয়ে রইলেন।
খাইরুন প্রকাশনী এ গ্রন্থখানি প্রকাশ করে জাতির কাছে ভালো ভালো গ্রন্থ উপহার দেওয়ার তাদের যে ওয়াদা তা পূরণ করে যাচ্ছে।
প্রকাশক
লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
নাম ও বংশ পরিচয় : নাম সাইয়েদ। কুতুব তাঁদের বংশীয় উপাধি। তাঁর পূর্বপুরুষগণ আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিসরের উত্তরাঞ্চলে মূসা নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী ইব্রাহীম কুতুব। মায়ের নাম ফাতিমা হুসাইন ওসমান। তিনি অত্যন্ত দ্বীনদার ও আল্লাহভীরু মহিলা ছিলেন। সাইয়েদ কুতুব ১৯০৬ সনের ২০শে জানুয়ারী শুক্রবার পিত্রালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বড় সন্তান। মেজো মুহাম্মদ কুতুব। তারপর তিন বোন, হামিদা কুতুব, আমিনা কুতুব, তৃতীয় বোনের নাম জানা যায়নি।
শিক্ষা জীবন: মায়ের ইচ্ছোনুযায়ী তিনি শৈশবেই পবিত্র কুরআন কণ্ঠন্ষ (হিফয) করেন। তারপর গ্রাম্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করে দেয়া হয়। তখনকার একটি আইন ছিল, কেউ যদি তার সন্তানকে মিসরে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ৈ পড়াতে ইচ্ছে করতেন তাহলে সর্বপ্রথম তাকে কুরআন হিফ্য করাতে হতো। যেহেতু পিতা-মাতার ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল তাদের বড় ছেলে সাইয়েদকে আল-আজহারে পড়াবেন, তাই তাকে হাফেযে কুরআন বানান। পরবর্তীতে পিতা মূসা গ্রাম ছেড়ে কায়রোর উপকণ্ঠে এসে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন এবং তাঁকে তাজহীযিয়াতু দারুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। এ মাদ্রাসায় শুধু তাদেরকেই ভর্তি করা হতো যারা এখান থেকে পাশ করে কায়রো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাইত। তিনি এ মাদ্রাসা থেকে ১৯২৯ সনে কৃতিত্বের সাথে পাশ করে দারুল উলুম কায়রো (বর্তমান নাম কায়রো ইউনিভার্সিটিতে) ভর্তি হোন। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৩৩ সনে বি, এ, পাশ করেন এবং ডিপ্লোমা-ইন-এডুকেশন ডিগ্রী লাভ করেন। এ ডিগ্রীই তখন প্রমাণ করতো, এ ছেলে অত্যন্ত মেধাবী।
কর্মজীবন: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নেবার পর সেখানেই তাঁকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বেশ কিছুদিন সফলভাবে অধ্যাপনা করার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। এ পদটি ছিল মিসরে অত্যন্ত সম্মানজনক পদ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেই তাঁকে ১৯৪৯ সনে শিক্ষার ওপর গবেষণামূলক উচ্চতর ডিগ্রী সংগ্রহের জন্য আমেরিকা পাঠানো হয়। সেখানে দু’বছর লেখাপড়া ও গবেষণা শেষে ১৯৫১ সনে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আমেরিকা থাকাকালিন সময়েই বস্তুবাদী সমাজের দুরাবস্থা লক্ষ্য করেন এবং তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে, একমাত্র ইসলামই আক্ষরিক অর্থে মানব সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে।
এরপর তিনি দেশে ফিরে ইসলামের ওপর ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণা শুরু করেন। সেই গবেষণার ফসল ‘কুরআনে আঁকা কিয়ামতের চিত্র’ ও ‘আল কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য’।
ইসলামী আন্দোলনে যোগদান : আমেরিকা থেকে ফিরেই তিনি ‘ইখওয়ানুল মুসলিমুন’ নামক ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কর্মসূচী যাচাই করে মনোপুত হওয়ায় ঐ দলের সদস্য হয়ে যান। ১৯৫২ সনের জুলাই মাসে তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তখন থেকে তিনি পরিপূর্ণ ইসলামী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫৪ সনে সাইয়েদ কুতুবের সম্পাদনায় ইখওয়ানের একটি সাময়িকী প্রকাশ করা হয়। কিন্দু দু’মাস পরই কর্ণেল নাসেরের সরকার তা বন্ধ করে দেন।
গ্রেফতার ও শাস্তি: শুরু হয় ইখওয়ান নেতা ও কর্মীদেরকে গ্রেফতার ও নির্যাতন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিল। সাইয়েদ কুতুবকে বিভিন্ন জেলে রাখা হয় এবং তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁরই এক সহকর্মী জনাব ইউসুফ আল আযম লিখেছেন: ‘নির্যাতনের পাহাড় তাঁর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল্ তাঁকে আগুনে ছ্যাঁকা দেয়া হতো, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হতো, মাথার ওপর কখনো অত্যন্ত গরম পানি আবার কখনো অত্যন্ত ঠান্ডা পানি ঢালা হতো। লাথি, ঘুষি, বেত্রাঘাত ইত্যাদির মাধ্যমেও নির্যাতন করা হতো, কিন্তু তিনি ছিলেন ঈমান ও ইয়াকীনে অবিচল- নির্ভিক।– (শহীদ সাইয়েদ কুতুব’ পৃষ্ঠা-৩০)
১৯৫৫ সনের ১৩ই জুলাই বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁকে পনের বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তাঁকে নির্যাতন করে এতো অসুস্থ ও দুর্বল করা হয়, যার ফলে তিনি আদালতে পর্যন্ত হাজির হতে পারেননি। এক বছর সশ্রম দণ্ড ভোগের পর নাসের সরকার তাকে প্রস্তাব করেন, তিনি যদি সংবাদপত্রের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। মর্দে মুমিন এ প্রস্তাবের যে উত্তর দিয়েছিলেন তা যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেছিলেন:
আমি এ প্রস্তাবে এ কারণেই বিস্ময় বোধ করছি যে, একজন জালিম কি করে একজন মজলুমকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলতে পারে। আল্লাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে তবু আমি এরূপ উচ্চারণ করতে রাজী নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমনভাবে পৌঁছুতে চাই যে, তিনি আমার ওপর এবং আমি তাঁর ওপর সন্তুষ্ট।
জেল থেকে মুক্তি লাভ: ১৯৬৪ সনের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ মিসর সফরে যান এবং তিনি সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করেন। ফলে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তিনি জেলে থাকা অবস্থায় দীর্ঘ ১০ বছরে বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর “ফি যিলালিল কুরআন’ রচনা করেন।
দ্বিতীয়বার গ্রেফতার ও শাহাদাত:
এক বছর যেতে না যেতেই তাঁকে ক্ষমতা দখলের চেষ্টার অপবাদ দিয়ে আবার গ্রেফতার করা হয়। সাথে চার ভাই-বোনসহ বিশ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় ৭শ’ মহিলাও ছিল।
অতঃপর নামমাত্র বিচার অনুষ্ঠান করে তাঁকে এবং তাঁর দুই সাথীকে ফাঁসির নির্দেশ দেয়া হয় এবং ১৯৬৬ সনের ২৯শে আগস্ট সোমবার তা কার্যকর করা হয়। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
সাইয়েদ কুতুব রচিত গ্রন্থাবলী
(ক) গবেষণামূলক:
(১) ফী যিলালিল কুরআন (৬ খণ্ড)
(২) আত তাসবীরুল ফান্নী যিল কুরআন (আল কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য)
(৩) মুশাহিদুল কিয়ামতি ফিল কুরআন (কুরআনের আঁকা কিয়ামতের চিত্র)
(৪) আল আদালাতুল ইজতিমাইয়্যা ফিল ইসলাম (ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার)
(৫) আস সালামুল ‘আ’লামী ওয়াল ইসলাম (বিশ্বশান্তি ও ইসলাম)
(৬) দারাসাতে ইসলামীয়্যা (ইসলামী রচনাবলী)
(৭) মা’রিফাতুল ইসলাম ওয়ার রিসালিয়াহ (ইসলাম ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব)
(৮) নাহ্বু মুজতামিউ’ ইসলামী (ইসলামের সমাজ চিত্র)
(৯) মুয়াল্লিম ফিত্ তরীক (ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা)
(১০) হাযা আদ্ দ্বীন (ইসলাম একটি জীবন ব্যবস্থা)
(খ) কাব্য ও কবিতা
১। কাফিলাতুর রাকীক (কাব্য)
২। হুলমুল ফাজরী (কাব্য)
৩। আল শাতিয়্যুল মাজহুল (কাব্য)
(গ) উপন্যাস:
১। আশওয়াক (কাঁটা)
২। তিফলে মিনাল ক্বারিয়া (গ্রামের ছেলে)
৩। মদীনাতুল মাসহুর (যাদুর শহর)
(ঘ) শিশু-কিশোরদের জন্য:
১। কাসাসুদ দীনিয়াহ্ (নবী কহিনী)
(ঙ) অন্যান্য:
১। মুহিম্মাতুশ শায়ির ফিল হায়াত (কবি জীবনের আসল কাজ)
২। আল আত্ইয়াফুল আরবাআ (চার ভাই বোনের চিন্তাধারা)
৩। আমেরিকা আলআতি রাআইতু (আমার দেখা আমেরিকা)
৪। কিতাব ওয়া শাখছিস্যাত (গ্রন্থ ও ব্যক্তিত্ব)
৫। আন নাকদুল আদাবী উছুলুহু ওয়া মানাহাজাহু (সাহিত্য সমালোচনার মূলনীতি ও পদ্ধতি)
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নিবেদন
মুহতারামা আম্মা! আমি এ গ্রন্থখানাকে আপনার নামে নিবেদন করছি।
প্রিয় মা আমার! স্মৃতিপটে একটা কথা এখনো জ্বলজ্বল করছে, প্রতিটি রমযান মাস এলে কারী সাহেব আমাদের ঘরে এসে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা তা কান লাগিয়ে পর্দার আড়াল থেকে তন্ময় হয়ে শুনতেন। যখন আমি শিশুসুলভ চীৎকার জুড়ে দিতাম তখন আপনি ইঙ্গিতে আমাকে চুপ করতে বলতেন। তখন আমিও আপনার সাথে কুরআন শ্রবণে শরীক হয়ে যেতাম। যদিও আমি তখন তা অনুধাবন করতে সক্ষম ছিলাম না। কিন্তু আমার মনে আক্ষরিক উচ্চারণগুলো বদ্ধমূল হয়ে যেতো। তারপর আমি যখন আপনার হাত ধরে হাটতে শিখলাম তখন আপনি আমাকে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আপনার বড় ইচ্ছে ছিল আল্লাহ যেন তাঁর কালামকে কণ্ঠস্থ করার জন্য আমার হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেন। অবশ্য আল্লাহ আমাকে খুশ ইলহানের মতো নিয়ামত দান করেছেন। আম যেন আপনার সামনে বসে প্রায় সময় তা তিলাওয়াত করতে পারি। আমি পূর্ণ কুরআন হিফজ করে নিলাম। আপনার অহংকার একটি অংশ পূর্ণ হয়ে গেল।
প্রিয় আম্মা আমার! আজ আপনি আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু এখনো আপনার সেই ছবি আমার স্মৃতিপটে অম্লান। ঘরে আপনি রেডিও সেটের কাছে বসে যেভাবে কারী সাহেবের তিলাওয়াত শুনতেন, আমি আজও সে স্মৃতি ভুলতে পারিনি। তিলাওয়াত শ্রবণরত অবস্থায় মুখমণ্ডল যে সুন্দর ও পবিত্র রূপ ধারণ করতো, আপনার মন-মস্তিষ্কে তার যে প্রভাব পড়তো সে স্মৃতি আজও মূর্তমান আমার হৃদয় পটে।
ওগো আমার জন্মদাত্রী! আপনার সেই মা’সুম শিশুটি আজ নওজোয়ান যুবক। আপনার সেই চেষ্টার ফসল আজ আপনার নামে নিবেদন করছি। আল্লাহ যেন আপনার কবরের ওপর ভোরে শিশিরের মতো শান্তি অবতীর্ণ করেন এবং আপনার সন্তানকেও যেন মাহফুজ রাখেন।
আপনার সন্তান
সাইয়েদ কুতুব
অনুবাদকের কথা
আপনি কি কুরআন বুঝতে চান? কুরআন যে এক জীবন্ত মুজিযা, সম্মোহনী শক্তির উৎস তা কি স্বীকার করেন? আপনি কুরআন পড়েন ঠিকই কিন্তু তা আপনাকে পুরোপুরি আকৃষ্ট করতে পারে না, কিন্তু কেন? এ কুরআনে এমন কাহিনি আছে যা রূপকথাকেও হার মানায়, এমন ছবি আছে যা আজ পর্যন্ত কোন শিল্পীই আঁকতে পারেনি, এমন সুরের মুর্ছনা ও ব্যাথার রাগিনী আছে যা সমস্ত সুরের জগতকে আচ্ছন্ন করে রাখে- এগুলোর সাথে আপনার পরিচয় হয়েছে কি? না হলে আল-কুরআন জনাব সাইয়েদ কুতুবের এ গ্রন্থখানা পড়ুন। এটি আপনাকে দেবে এক নতুন দিগন্তের পথ-নির্দেশ। আপনার সামনে উন্মক্ত করে দেবে কুরআনের সমস্ত রহস্যের দ্বার। আপনি হারিয়ে যাবেন কুরআনের অসীমতায়, অতল গহনে। কোন শক্তিই আপনাকে ফেরাতে পারবে না সে গভীর মায়াপুরী থেকে।
সাইয়েদ কুতুব একজন গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন, এ পরিচয়েই ইসলামী দুনিয়া তাঁকে চেনেন। কিন্তু তিনি যে আধুনিক আরবী সাহিত্যের উঁচুস্তরের একজন সাহিত্যিক ছিলেন এবং তিনি ছিলেন এক অমর কথাশিল্পী সে কথা ক’জন খবর রাখেন। শুধু তাই নয়, শিল্পকলা, ললিত কলা, চারু ও কারুকলা ইত্যদি বিষয়েও তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাই আল-কুরআনকে তিনি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। কারাজীবনে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন তিনি এ কুরআন নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তিনি ছিলেন একদিকে হাফেজে কুরআন, অপরদিকে তাঁর মাতৃভাষা ছিল আরবী, আর এ দুটো দিকই গবেষণা কর্মে তাঁকে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তিনি নিজেই বলেছেন:
আমার মতে এক অধক ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তা’আলার এক বিরাট অনুগ্রহ, আমি যখন আল-কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছি, তখন তিনি আমার জন্য রহমতের সব ক’টি দরজা খুলে দিয়েছেন এবং আমাকে আল-কুরআনের রূহের এতো নিকটবর্তী করে দিয়েছেন, মনে হয় যেন কুরআন নিজেই বুঝি আমার জন্য তার সমস্ত সত্য ও রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। -(ফী যিলালিল কুরআনের মূল ভূমিকা থেকে)
এ মূল্যবান গ্রন্থখানার পরতে পরতে সাহিত্যের ছোঁয়া, এটি বিনিসূতার এক কথামালা। ভাষা এতো উন্নত ও সমৃদ্ধ যে, আমি ইতোপূর্বে তিনবার এ গ্রন্থখানা অনুবাদে মনস্থ করে বিরত রয়েছি। সাহস পাইনি। তাই বলে এটি অনুবাদের লোভও সম্বরণ করতে পারিনি। পরিশেষে চতুর্থবারে মহান আল্লাহর কাছে কুকুতি মিনতির সাথে কৃপাভিক্ষা চেয়ে এ মহান কাজে হাত দিয়েছি। কাজ পিঁপড়ের গতিতে আগালেও করুণাময়ের রহমতের পরশে তা পূর্ণতায় পৌছে গেল। তবে সাহিত্যের সেই উচ্চ মানটা পুরোপুরি ধরে রাখতে পেরেছি সে দাবি আমি করছি না, কিন্তু লেখক যা বুঝাতে চেয়েছেন তা আপনাদের সামনে হুবহু উপস্থাপরে স্বেচ্ছায় কোন ত্রুটি করিনি। তারপরও কথা থেকে যায়, আমি একেতো কোন বড় আলিম নই। তারপর আধুনিক আরবী সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান নেই বললেই চলে, তদুপরি আমি এক দুর্বল মানুষ,ভুল-ত্রুটিই যার নিত্যদিনের সাথী। তাই এ কাজ করতে গিয়েও হয়তো কোন জায়গায় ভুল করে থাকতে পারি, যা আমি এখনো অবগত নই। যদি কোন আল্লাহর বান্দার নিকট এ ধরনের কোন ভুল-ত্রুটি দৃষ্টিগোচর হয় তবে মেহেরবানী করে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আমি পরবর্তী সংশোধন করে দেবার চেষ্টা করবো, ইনশা আল্লাহ্।
পরিশেষে দরবারে ইলাহীতে নতশিরে প্রার্থনা, তিনি যেন এ গ্রন্থের লেখককে জান্নাতে উচ্চ মর্যাদান প্রদান করেন। তার সাথে এ অধম অনুবাদক, প্রকাশক ও পাঠকগণকেও যেন আল্লাহ মা’ফ করে দেন এবং জান্নাতে লেখকের সাথে মিলিত হবার তওফিক দেন। আরো মিনতি এই যে, লেখকের মতো আমাদের কাছেও যেন আল্লাহ তাঁর কুরআনে হাকীমের সমস্ত রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। আমীন।
বিনীত
মুহাম্মদ খলিলুর রহমান মুমিন
লেখকের কথা
আমি কুরআনকে কিভাবে পেয়েছি?
এ মুহূর্তে আপনার হাতে যে বইটি আছে তা শুরু করার আগে এর আনুসাঙ্গিক একটি ঘটনা বলে নেয়া দরকার। যতোক্ষণ এ বইটি আমার স্মৃতিপটে সংরক্ষিত ছিল, নির্দিষ্ট কোন আকার আকৃতিতে ছিল না, ততোক্ষণ সে ঘটনাটিকে বর্ণনা করার তেমন প্রয়োজনও ছিল না। যখন এটি অস্তিত্ব লাভ করার জন্য ছাপাখানার টেবিলে গেল, তখন ঘটনাটিও আর নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রিইলো না। এখন তা প্রকাশ হওয়াই দরকার।
তখন আমি খুব ছোট্ট। সবেমাত্র কুরআন পড়া শুরু করেছি, কিন্তু এর মর্মার্থ বা পাঠোদ্ধার ছিল আমার আয়ত্বের বাইরে। তাছাড়া এর উচ্চমানের বিষয়বস্তুগুলো আমার জ্ঞানের পরিসীমায় আবদ্ধ করা, তাও ছিল অসম্ভব। তবু আমি এর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছি। তিলাওয়াতের সময় আশ্চর্যজনক বহু ঘটনা আমার মনের পর্দায় উঁকি মারতো। এ ছবিগুলো ছিল সাদাসিদা ও রঙহীন। তবু আমি তা আগ্রহ উদ্দীপনার সাথে বার বার কল্পনা করতাম। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সে ধারা অব্যাহত ছিল এবং আমাকে তা আনন্দ দিত।
সাদাসিদা এ ছবিগুলোর মধ্যে যেগুলো আমার মনমগজে বদ্ধমূলণ হয়ে ছিল তার একটি ছবি নিম্নোক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করা মাত্র আমার সামনে ভেসে উঠতো।
(আরবী**********)
মানুষের মধ্যে এমন কতিপয় লোক আছে যারা প্রান্তিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি পার্থিব কোন স্বার্থ দেখে, সেদিকে ঝুকে পড়ে। আর যদি কোন বিপদ পরীক্ষায় নিমজ্জিত হয় তখন তাদের চেহারাকে ঘুরিয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে তারা ক্ষতিগ্রস্ত দুনিয়ায় এবং আখিরাতে। (সূরা আল-হাজ্জ : ১১)
এই খেয়ালী ছবিটি যদি আমি কারো সামনে উপস্থাপন করি, তার হাসা উচিত নয়। এ আয়াত শোনা মাত্র আমার স্মৃতিপটে যখন এ ধরনের ছবি ভেসে ওঠতো তখন আমি এক গ্রামে থাকতাম। গ্রামের পাশে উপত্যকার মাঝে একটি টিলার ওপর দাঁড়িয়ে নামায পড়ছে কিন্তু সে সংকীর্ণ টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, তা থর থর করে শুধু কাঁপছে। যে কোন মুহূর্তেই ভেঙ্গে পড়তে পারে। আমি দূরে দাঁড়িযে এ অবস্থা দেখেছি এবং মনে মনে আশ্চর্য ও রোমাঞ্চিত হয়েছি।
এ রকম যে সমস্ত কল্পিত ছবি আমার মানসপটে ভেসে বেড়াতো তার একটি ছবি নিম্নোক্ত আয়াত পাঠে প্রতিভাত হয়ে উঠতো। আয়াতটি হলো:
(আরবী**************)
আর আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন, সেই লোকের অবস্থা, যাকে আমি নিজের নিদর্শনসমূহ দান করেছিলা, অথচ সে তা পরিহার করে বেরিয়ে গেছে। আর তার পেছনে লেগেছে শয়তান, ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। অবশ্য আমি ইচ্ছে করলে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিতাম কিন্তু সেতো জমিনের দিকেই ঝুঁকে থাকে এবং নিজের নফসের খাহেস পূরণেই নিমগ্ন হয়। তার অবস্থা কুকুরের মতো। তার ওপর আক্রমণ করলে জিহ্বা বের করে হাঁপাবে আর যদি ছেড়ে দাও তবু জিহ্বা বের করেই রাখবে। (সূরা আল-আ’রাফ: ১৭৫-১৭৬)
আমি এ আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতাম না। কিন্তু তিলাওয়াত করা মাত্রই আমার মনের মুকুরে একটি ছবি এসে উপস্থিত হতো। দেখতাম, এক ব্যক্তি হা করে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার কাছে এসে দাড়াতো। আমি অপলক নেত্রে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম না, কেন সে এরূপ করছে। তবে আমি তার কাছে এগিযে যেতে সাহস পেতাম না। এমনি ধরনের হাজারো ছবি আমার খুব ভালো লাগতো। ফলে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি আমার এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতাম, আর কল্পনার তেপান্তরে সেই ছবি খুঁজে বেড়াতাম।
সেই সময়টি আমার মধুর কল্পনা র বালখিল্যতার সাথেই অতিবাহিত হয়ে গেল। এখন কালের আবর্তনে কিছুটা ইলম ও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। কিছু তাফসীর গ্রন্থ নিজের প্রচেষ্টায় ও শিক্ষকদের সহায়তায় বুঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সুন্দর, সুমধুর ও মহিমান্বিত কুরআন তিলাওয়াতের সময় শৈশবে কী করেছি তার দিকে কোন দৃষ্টি যায় না। তবে কি আজকের কুরআন শৈশবের সেই কুরআন থেকে ভিন্নতর? এর মধ্যে কি কোন-ই সম্পর্ক নেই? সম্ভবত তা ছিল মনগড়া ব্যাখ্যার তেলসমতি।
আল কুরআনের বেশ কিছু তাফসীর দেখার পরেও মনে হলো, কোথায় যেন একটু ফাঁক রয়ে গেছে। তখন আমি সরাসরি কুরআন থেকে কুরআনকে বুঝার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করলাম। আশ্চর্য হলেও সত্যি, তখনই আমি সেই প্রিয় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত কুরআনের সন্ধান পেলাম। সেই আকর্ষণীয় মনোরম ছবি আবার আমার সামনে ভেসে ওঠলো। শুধু পার্থক্য ছিল তা আগের মতো সাদাসিদা না হয়ে বুঝের পরিপক্কতার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। তখন আমি বুঝতে পারলাম এ ছবি নয়, উপমা। শুধু কুরআন বুঝার জন্য বর্ণনা করা হয়েছে। মূলত তা কোন বাস্তব ঘটনার প্রতিচ্ছবি নয়। তাই বলে তা অবাস্তব কোন কিছুও নয়।
আলহামদু লিল্লাহ! এবার আমি পূর্ণ মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন শুরু করলাম। হঠাৎ আমার মনে খেয়াল সৃষ্টি হলো, আমি যে ছবিগুলো দেখছি তা সাধারণের সামনে উপস্থাপন করবো, যেন তারা এ থেকে কিছু উপকৃত হতে পারে। তাই ১৯৩৯ সনে ‘আল মুকতাতাফ’ নামক পত্রিকার মাধ্যমে ‘আল-কুরআনের কতিপয় ছবি ও তার শৈল্পিক সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করা হয়।
আমি সেখানে প্রমাণ করে দেখিয়েছি, আল-কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে সমস্ত ছবি একেছেন তা কোন রঙ্গিন ক্যামেরায় বা কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা সম্ভব নয়। সে এক সমস্যময় মোহিত ছবি। সেখানে আমি এও বলেছিলাম যে, এ বিষয়ে স্বতন্ত্র একটি পুস্তক রচনা করাও সম্ভব।
তারপর ক’বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। এদিকে কুরআনী ছবিগুলো আমার মনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলতে লাগলো। আমি এর সর্বত্র শৈল্পিক সৌন্দর্যের সন্ধান পেতে থাকলাম। তখন আমি মনে করলাম, আমি একে পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে যাই যে বিষয়ে আজও কেউ কলম ধরেনি। এ উদ্দেশ্যে আল-কুরআন অধ্যয়নে গভীরভাবে মনোনিবেশ করি এবং তা থেকে সেই সূক্ষ্ম ছবিগুলো একত্রিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সত্ত্বেও কাজের গতি মন্থর হয়ে যেতো।
অবশেষে আল্লাহর নাম নিয়ে সংকলনে হাত দিলাম। আমার কাজ ছিল আল-কুরআনের শৈল্পিক ছবিগুলোকে একত্রিত করা এবং তার রচনা শৈলীঅ ও শৈল্পিক সৌন্দর্য সম্পর্কে আলোকপাত করা। আল-কুরআনের শাব্দিক বিশ্লেষণ ও ফিকহী আলোচনা করার কোন উদ্দেশ্য আমার ছিল না।
যখন আমি অগ্রসর হচ্ছি তখন এক নতুন রহস্য আমার সামনে উদ্ভাসিত হলো। লক্ষ্য করলাম আল-কুরআনের আঁকা ছবিগুলো অন্যান্য আলোচনা ও অংশ থেকে পৃথক কিছু নয়। এর আলাদা কোন অবস্থানও নেই। বরং গোটা কুরআনের বর্ণনা ভঙ্গিটাই হচ্ছে দৃশ্য ও ছবির শৈল্পিক বুনিয়াদ। শুধু শরয়ী নির্দেশগুলো এর ব্যতিক্রম। তখন আমি ছবিগুলো একত্রিত করার চেয়ে তার আসল উদ্দেশ্য ও সূত্র উদ্ভাবনে মনোযোগী হলাম, তারপর সেই সূত্র ও তার ব্যাখ্যা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম। যা আজ পর্যন্ত কেউ স্পর্শও করেনি।
সংকলনের কাজ যখন শেষ, তখন মনে হলো কুরআন এক নতুন রূপে আমার মনে আবির্ভূত হলো। আমি এমন এক কুরআনের সন্ধঅন পেলাম যা ইতোপূর্বে আর কখনো পাইনি। আগেও কুরআন আমার কাছে সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল্ তবে তা ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত আকারে। এখন পুরো সৌন্দর্য যেন অবিচ্ছিন্ন রূপে দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। এ যেন এক বিশেষ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যার মধ্যে আশ্চর্য ও বিরল সম্পর্ক বিদ্যমান। যা কোন দিন আমি অনুধাবন করতে পারিনি। যার স্বপ্নও আমি কখনো দেখিনি। এমনকি অন্য কেউ কোন দিন তা কল্পনা করেনি।
আল-কুরআনের এসব দৃশ্যাবলী ও চিত্রসমূহের উপস্থাপনে আমার ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার যথাযথ দাবি আদায় করার ব্যাপপারে যদি আল্লাহ আমাকে তওফিক দেন তাহলে সেটিই হবে এ পুস্তকের পূর্ণাঙ্গ সাফল্যের মাপকাঠি।
প্রথম অধ্যায়
আল-কুরআনের সম্মোহনী শক্তি
আল-কুরআন অবতীর্ণের প্রাক্কালে স্বয়ং কুরআনই আরবদেরকে এর সম্মোহনী শক্তিতে সম্মোহিত করেছিল। যার অন্তরকে আল্লাহর ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল তিনি এবং যাদের মনের ওপর ও চোখের ওপর পর্দা পড়ে গিয়েছিল তারাও এ কুরআনের সম্মোহনী প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যদিও তারা এ কুরআন থেকে কোন উপকৃত হতে পারেনি। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তিত্ব এমন ছিল, যারা শুধুমাত্র নবী করীম (স)-এর স্ত্রী মুহতারামা খাদিজা (রা), তাঁর মুক্ত করা ক্রীতদাস হযরত যায়িদ (রা) প্রমুখ। এঁদেরকে ছাড়া প্রাথমিক অবস্থায় যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তখন রাসূল (সা) এতো বেশি শক্তি ও ক্ষমতাশালী ছিল না যে, তাঁরা তাঁর ক্ষমতা ও শক্তিমত্তায় বিমোহিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। বরং তাঁদের ইসলাম গ্রহণের মূলে ছিল আল কুরআনের মায়াবী আকর্ষণ।
হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা এবং ওয়ালীদ বিন মুগিরার প্রভাবিত হওয়ার ঘটনা দু’টো উপরোক্ত বক্তব্যকেই স্বীকৃতি দেয় এবং প্রমাণ করে যে, আল-কুরআনের সম্মোহনী শক্তি অত্যন্ত প্রবল। যা শুধু ঈমানদারদেরকেই নয়; বরং কাফিরদেকেও প্রভাবিত করতো।
হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ
হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণ প্রসঙ্গে আতা ও মুজাহিদ এর রিওয়ায়েতে বর্ণনা করেছেন, যা ইবনে ইসহাক আবদুল্লাহ বিন আবু নাজীহ থেকে সংকলন করেছেন, হযরত উমর (রা) বলেন:
আমি সেদিনও ইসলাম থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেছিলা, শরাব পানে মত্ত থাকতাম। আমাদের এক মিলনায়তন ছিল, যেখানে কুরাইশরা এসে জমায়েত হতো। সেদিন আমি তাদের সন্ধানে গেলাম কিন্তু কাউকে সেখানে পেলাম না। চিন্তা করলাম অমুক শরাব বিক্রেতার নিকট যাব, হয়তো সেখানে তাদেরকে পেয়েও যেতে পারি। কিন্তু সেখানেও তাদের কাউকে আমি পেলাম না। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, মসজিদে হারামে গিয়ে তাওয়াফ করিগে। সেখানে গেলাম। দেখলাম হযরত মুহাম্মদ (স) নামাযে মশগুল। তিনি শামের (সিরয়ার) দিকে মুখ করে নামাযে দাঁড়িয়েছেন। কা’বা তাঁর ও শামের মাঝে অবস্থিত। তিনি রুকনে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়েমেনীর মাঝখানে দাঁড়িযে নামায পড়ছেন। তাঁকে দেখে ভাবলাম, আজ রাতে আমি চুপি চুপি শুনবো, তিনি কী পড়ছেন। তাঁকে দেখে ভাবলাম, আজ রাতে আমি চুপি চুপি শুনবো, তিনি কী পড়েন। আবার মনে হলো, যদি শোনার জন্য কাছে চলে যাই তবে তো আমি ধরা পড়ে যাব। তাই হাতিমের দিক থেকে এসে খানায়ে কা’বার গেলাফের নিচে চুপ করে দাঁড়িয়ে রেইলাম। আমার ও তাঁর মাঝে একমাত্র কা’বার গেলাফ ছাড়া অন্য কোন আড়াল ছিল না। যখন আমি নবী করীম (স)-এর তিলাওয়াত শুনলাম তখন আমার মধ্যে এক ধরনের ভাবান্তর সৃষ্টি হলো। আমি কাঁদতে লাগলাম।আর পরিণতিতে আমার ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য হয়।
ইবনে ইসহাকের আরেক বর্ণনায় আছে- একদিন উমর (রা) রাসূলে করীম (স)-কে হত্যা করার জন্য নগ্ন তরবারী নিয়ে রওয়ানা হলেন। সাফা পাহাড়ের পাদদেশে কতিপয় সাহাবীর সাথে নবী করীম (স) একটি ঘরে বসবাস করতেন। সেখানে প্রায় চল্লিশ জনের মতো পুরুষ ও মহিলা ছিল। পথিমধ্যে নাঈম বিন আবদুল্লাহর সাথে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন: উমর! কোথায় যাচ্ছ? উমর তাঁর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। নাঈম বললেন: বনী আবদে মুনাফের শত্রুতা পরে কারো, আগে নিজের বোন ফাতিমা এবং ভগ্নিপতি সাঈদ বিন যায়িদকে সামলাও। তারা মুসলমান হয়ে গেছে। তখন হযরত ওমর (রা) সেখানে গিয়ে দেখলেন, খাব্বাব (রা) তাদেরকে কুরআন শরীফ পড়াচ্ছেন।
উমর (রা) সরাসরি দরজার ভেতর ঢুকেছিল এবং ভগ্নিপতি সাঈদকে ধরে ফেললেন। নিজের বোন ফতিমাকে মাথায় আঘাত করে রক্তাক্ত করে দিলেন। কিছুক্ষণ বাক-বিতণ্ডার পর তারা যা পড়ছিল, তা দেখতে চাইলেন। তখন সূরা ত্ব-হা থেকে কিছু অংশ পাঠ করে তাকে শুনানো হলো। যখন সূরা ত্ব-হা’র কিছু অংশ শুনালেন, তখন মন্তব্য করলেন, ‘এতো অতি উত্তম কথাবার্তা’। তাপর তিনি রাসূলে করীম (স)-এর নিকট গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
এ বিষয়ে সমস্ত বর্ণনার মূল কথা একটি। তা হচ্ছে হযরত উমর (রা) কুরআনের কিছু অংশ পড়ে অথবা শুনে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। আমরা তো এ ঘটনা শুনি কিংবা বলি কিন্তু এদিকে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়না যে, হযরত উমর (রা)-এর পরিবর্তন হয়েছিল, তার মূলে ছিল আল-কুরআনের আকর্ষণ ও অপ্রতিরোধ্য সম্মোহনী শক্তি।
ওয়ালীদ বিন মুগিরার ঘটনা
ওয়ালীদ বিন মুগিরা কুরআনে হাকীমের কিছু অংশ শুনে তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এটি দেখে কুরাইশরা বলাবলি শুরু করলো, সে মুসলমান হয়ে গেছে। ওয়ালীদ ছিল কুরাইশদের মধ্যে এক সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত ব্যক্তি। আবু জাহেলকে তার কাছে পাঠানো হলো। যেন সে কুরআনের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের কথা ঘোষণা দেয় যাতে কুরাইশরা তার ঐ কথায় প্রভাবিত হয়। ওয়ালিদ বলতে লাগলো: “আমি কুরআন সম্পর্কে কী বলবো? আল্লাহর কসম! আমি কবিতা ও কাব্যে তোমাদের চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখি কিন্তু মুহাম্মদের কাছে যে কুরআন শুনেছি তার সাথে এগুলোর কোন মিল নেই। আল্লাহর শপথ! তার কাছে যা অবতীর্ণ হয় তা অত্যন্ত চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর এবং তা প্রাঞ্জল ভাষায় অবতীর্ণ। যা তার সামনে আসে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। ওটি বিজয়ী হওয়অর জন্য এসেছে পরাজিত হতে আসেনি।”
একথা শুনে আবু জাহেল বললো: ‘যতোক্ষণ তুমি কুরআনকে অবজ্ঞা না করবে ততোক্ষণ তোমার কওম তোমার ওপর নারাজ থাকবে।’ ওয়ালীদ বললো: ‘আমাকে একটু চিন্তা করার অবকাশ দাও।’ তারপর সে ঘোষণা দিলো: ‘এতো সুস্পষ্ট যাদু, তোমরা দেখো না, যে এর সংস্পর্শে যায় তাকেই তার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।[সীরাতে ইবনে হিশাম ও তাফসীরে ইবনে কাসীরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। -লেখক।]
এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে বলা হয়েছে:
(আরবী**************)
সে চিন্তা করেছে এবং মনস্থির করেছে। সে ধ্বংস হোক, কিভাবে সে মনস্থির করেছে, (আবার বলছি) সে ধ্বংস হোক, কিভাবে সে মনস্থির করেছে! দেখেছে, সে আবার ভ্রুকুঞ্চিত ও মুখ বিকৃত করেছে। অতপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছে এবং অহংকার করে বলেছে: এতো লোক পরম্পায় প্রাপ্ত যাদু বৈ আর কিছুই নয়। (সূরা আল মুদ্দাসসির: ১৮-২৪)
এ হচ্ছে ঐ ব্যক্তির বক্তব্য যে ইসলামের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করতো। মুহাম্মদ (স)-এর নিকট পৌঁছুলে নিজের অজান্তেই তাদের মন ও মাথা ঝুঁকে পড়ে কিন্তু যখন বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরে আসে তখন সম্মান ও প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য বিদ্রোহ তাদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এতেই প্রমাণিত হয়, আল-কুরআনের আকর্ষণী শক্তি কতো তীব্র, যা যাদুকেও হার মানায়।
এবার চিন্তা করে দেখুন, আল-কুরআন হযরত উমর (রা) ও ওয়ালীদ বিন মুগিরা দু’জনের ওপরই প্রভাব ফেললৈা। কিন্তু তাদের আচার-আচরণে আসমান-জমিনের পার্থক্য। হযরত উমর (রা) আল্লাহকে ভয় পাবার কারণে আল্লাহ তাঁর দিলকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন।পক্ষান্তরে ওয়ালীদ বিন মুগিরাকে অহংকার, দাম্ভিকতা ও নেতৃত্বের মোহ ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিলো।
কুরআন মজীদে কাফিরদের কথার যে উদ্ধৃতি পেশ করা হয়েছে, তাও আল-কুরআনের সম্মোহনী শক্তির একটি প্রমাণ।
(আরবী***********)
তোমরা কুরআন শুনবে না এবং কুরআন পাঠের সময় চেঁচামেচি শুরু করবে, তাতে মন হয় তোমরা বিজয়ী হবে। (সূরা হা-মিম সিজদা: ২৬)
এখানেও আল-কুরআনের সম্মোহনী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের ভয় ছিল যদি সুষ্ঠুভাবে এ কুরআন শুনতে দেয়া হয় বা শোনা হয় তবে তার প্রভাব শ্রোতার ওপর অবশ্যই পড়বে এবং সে তার অনুসারী হয়ে যাবে। কাজেই সকাল-সন্ধ্যায় যেন কেউ কুরআন শুনে মোহগ্রস্থ হতে না পারে সেজন্যই শোরগোল করা বাঞ্ছনীয়। অবশ্য তাদেরকেও প্রতিনিয়ত কুরআন আকর্ষণ করছিল। কিন্তু যাদের ভেতর সামান্য মাত্রায় হলেও আল্লাহভীতি ছিল শুধু তারাই জাহেলিয়াতের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। যদি তারা এতে প্রভাবিত না হতো কিংবা প্রভাবিত হওয়ার ভয় না করতো তবে অনর্থক কেন তারা কুরআনের বিরুদ্ধে এতো কাঠখড় পোড়ালো? এতেই প্রমাণিত হয়, এ কুরআনের আকর্ষণ কত তীব্র, কতো দুর্নিবার।
আল-কুরআনে সুন্দরভাবে কুরাইশ কাফিরদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। যে বক্তব্য দিয়ে তারা কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত।
(আরবী***********)
তারা বলে: এগুলো তো পুরাকালের রূপকথা, যা সে লিখে রেখেছে। এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় তাকে শেখানো হয়। (সূরা আল-ফুরকান: ৫)
(আরবী************)
(তারা আল্লাহর কালাম শুনে বলেঃ) ইচ্ছে করলে আমরাও এমন বলতে পারি। এতো পুরোনো দিনের কিচ্ছা-কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়।
(আরবী************)
(এ কুরআন) অলীক স্বপ্ন মাত্র। বরং তার মনগড়া কথা, (না) বরং সে একজন কবি। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৫)
(আরবী*********)
হে রাসূল, তাদেরকে বলে দিন, (যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে) তোমরা এ রকম দশটি সূরা বানিয়ে নিয়ে এসো।
(আরবী***********)
(কিংবা) এ রকম একটি সূরাই তৈরী করে আনো। (সূরা বাকারা: ২৩)
কিন্তু তারা এ চ্যালেঞ্জের মুকাবেলায় একটি সূরাও তৈরী করতে সক্ষম হয়নি। দশটিতো অনেক দূরের কথা। সত্যি কথা বলতে কি, তারা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণই করেনি। অবশ্য নবী করীম (স)-এর ওফাতের পর কতিপয় কুলাঙ্গার নবুওয়াতের দাবি করেছিল বটে, কিন্তু তার পরিণতি ভালো হয়নি। তাদের এ বাতুলতাকে কেউ গুরুত্বই দেয়নি।
রাসূল (স) কর্তৃক ইসলামের দাওয়াতের প্রাক্কালে পূর্ববর্তী নবীর অনুসারীদের মধ্যে যারা সত্যিকার অর্থে আলিমও বুজুর্গ ছিলআল-কুরআনের প্রভাব তাদের ওপর তীব্রভাবেই পড়েছিল। ফলে তাঁরা আল-কুরআনের ছায়াতলে স্থান লাভ করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। সেসব ভাগ্যবানদের ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী************)
আপনি সব মানুষের মধ্যে ইহুদী ও মুশরিকদেরকেই মুসলমানদের অধিকতর শত্রু হিসেবে পাবেন। আর মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বে অধিক নিকটবর্তী পাবেন, যারা নিজেদেরকে খ্রীষ্টান বলে। এর কারণ খ্রীস্টানদের মধ্যে আলিম ও দরবেশে রয়েছে যারা অহংকার করে না। তারা রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার কথা শুনামাত্র দেখবেন তাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেছে। কারণ তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা আরো বলে: হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম, অতএব আমাদেরকে অনুগতদের তালিকাভুক্ত করে নিন। (সূরা আল-মায়িদাহ : ৮২-৮৩)
জানার তীব্র আকাংখার যে চিত্র পেশ করা হয়েছে তা শুধুমাত্র কুরআন শোনার মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছে।এমনকি কুরআন শুনে নিজেদের অজান্তেই তাদের চোখের পান পর্যন্ত নির্গত হয়েছে। ফলে তারা সত্যের মুখোমুখি হতে পেরেছেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল-কুরআন যে সত্যের দাওয়াত ও শিক্ষা দিতে চায় তা তার নিজস্ব প্রভাব ছাড়া কোন মতেই সম্ভব হতে পারে না। আল-কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে:
(আরবী*************)
যারা পূর্ব থেকেই আলিম, যখন তাদের সামনে কুরআন তিলাওয়াত করা হয় তখন তরা নত মস্তকে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। এবং বলে: আমাদের পালনকর্তা পবিত্র মহান। অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা পূর্ণ করা হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল: ১০৭-১০৮)
কুরআন শুনে আল্লাহকে ভয় করার চিত্র নিম্নোক্ত আয়াতেও তুলে ধরা হয়েছে:
(আরবী**********)
আল্লাহ উত্তম বাণী (অর্থাৎ কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ ও পুনঃ পুনঃ পঠিত। এতে তাদের লোমহর্ষণ হয় যারা তার প্রতিপালককে ভয় করে। অতঃপর তাদের চামড়া ও অন্তকরণ আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। (সূরা আয-যুমার: ২৩)
উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, এ কুরআনের মধ্যে এমন এক প্রবাব নিহিত আছে যা তার পাঠক কিংবা শ্রোতাকে প্রভাবিত না করে ছাড়ে না। হৃদয়কে করে উত্তাল, চোখকে করে অশ্রুসজল। যে ঈমান গ্রহণে আগ্রহী সে কুরআন শুনামাত্রই তার আনুগত্যের শির নত হয়ে যায়। এমনকি, যে কুফরী ও হঠকারিতায় নিমজ্জিত সে-ও যদি এ কুরআন শোনে তবে তার ওপরও কুরআন প্রভাব ফেলে, কিন্তু সে এটিকে যাদু মনে করে উড়িয়ে দেয়। লোকদেরকে তা শুনবে বারণ করে। তবু সে এ কুরআনকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহস পায় না।
আল-কুরআনে সম্মোহনী শক্তির উৎস
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আল-কুরআন আরবদেরকে কিভাবে পরাজিত করলো এবং ঈমানদার ও কাফিরদের মধ্যে এটি কিভাবে এমন প্রচণ্ড প্রভাব ফেললো?
যে সমস্ত মনীষী কুরআন বুঝার ব্যাপারে বিশেস পারদর্ষিতা অর্জন করেছেন এবং আল-কুরআনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখনী ধরেছেন তারা তাদের সাধ্যমতো এ ব্যাপারে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কতিপয় আলিম কুরআনী বিষয়বস্তুর মিল ও যোগসূত্র সম্পর্কে কিছু না বলে অন্যভাবে কিছুটা আলোচনা করেছেন। যা কুরআন এমন কিছু ঘটনাও বলে দিয়েছে যা পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই সংঘটিত হয়েছে। তাছাড়া কুরআন বিশ্বপ্রকৃতি ও মানব সৃষ্টি সম্পর্কেও আলোকপাত করেছে ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ আল-কুরআনের প্রচুর বর্ণনা করা হয়েছে। যা আল-কুরআনের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। কিন্তু ছোট ছোট সেই সব সূরার ব্যাপারে বক্তব্য কী, যেখানে কোন শরয়ী বিধান বর্ণনা করা হয়নি? কিংবা যেখানে কোন অদৃশ্য জগতের বিবরণ পেশ করা হয়নি বা পার্থিব জগতের কোন জ্ঞানও বিতরণ করা হয়নি? যদিও ছোট সেই সূরাগুলোতে সব বিষয়ের সামষ্টিক আলোচনা করা হয়নি (যা আল-কুরআনের অনেক সূরায় করা হয়েছে)। তবু আল-কুরআন অবতীর্ণের প্রথম দিকে সেগুলো আরবদেরকে সম্মোহন করেছিল। ঐ সূরাগুলোর মাধ্যমেই এসেছিল তাদের চিন্তার জগতের আলোড়ন এবং তার সৌন্দর্যের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। একথা স্বীকার করতেই হবে যে, এ ছোট সূরাগুলোর যাদুকরী প্রভাব এতো তীব্র ও অপ্রতিরোধ্য ছিল, যার কারণে শ্রোতা মোহগ্রস্ত না হয়ে পারতো না। আল-কুরআন স্বীয় বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে কাফির ও মুমিনদেরকে তার প্রভাব বলয়ে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছে। যারা ইসলাম গ্রহণ করে সৌভাগ্যশালী হয়েছেন, তাদের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে আল-কুরআন। একথা অস্বীকার করার কোন উপায়ই নেই যে, আল-কুরআনের ছোট একটি সূরা কিংবা তার অংশ বিশেষ তাদের জীবনের মোড়কে ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
অবশ্যি ইসলাম পূর্ণতা প্রাপ্তির পর যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের পেছনে আল-কুরআন ছাড়াও কিছু আচার-আচরণে এবং বাহ্যিক তৎপরতা ক্রিয়াশীল ছিল। তবে প্রাথমিক পর্যায়ের সৌভাগ্যবান মুমিনদের পেছনে ঈমানের ব্যাপারে যে বস্তুটি ক্রিয়াশীল ছিলতা কেবলমাত্র কুরআন ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইসলাম গ্রহণের মূল চালিকা শক্তি
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হবার পর বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়ে লোকজন ইসলাম গ্রহণ করেছিল। যেমন:
(১) কতিপয় লোক রাসূলে আকরাম (সা) ও সাহাবা কিরামের আমল ও আখলাকে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
(২) যারা ইতোপূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা সবকিছুর উর্ধ্বে দ্বীনকে প্রাধান্য দিচ্ছিলেন এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট-নির্যাতন ভোগ করছিল, কতিপয় লোক এ ব্যাপারে প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হয়েছিল।
(৩) কিছু লোক একথা চিন্তা করে ইসলাম গ্রহণ করেছিল যে, মুহাম্মদ (স) ও তার সঙ্গী সাথীরা সংখ্যায় অল্প কিন্তু তবু কোন পরাশক্তি তাদেরকে পরাস্ত করতে পারে না এটি আল্লাহর সাহায্য ও তত্ত্বাবধান ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না।
(৪) কতিপয় লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল তখন যখন ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ইসলামের ইনসাফ ও ন্যায়বিচার কার্যকরী ছিল। যা তারা ইতিপূর্বে কখনো দেখেননি।
এ রকম আরোম অনেক কারণেই মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তার মধ্যে অন্যতম ছিল আল-কুরআনের প্রাণস্পর্শী আবেদন ও মোহিনী টান। যা ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় এককভাবে অবদান রেখেছে।
আল-কুরআনে সম্মোহনী শক্তির উৎস কোথায়?
একটি কথা ভেবে দেখা দরকার, তখন পর্যন্ত শরীয়ত পরিপূর্ণ ছিল না, অদৃশ্য জগতের খবর ছিল না, জীবন ও জগৎ সম্পর্কেও জোরালোভাবে তেমন কিছু বলা হয়নি, ব্যবহারিক কোন দিক-নির্দেশনা তখনও কুরআন দেয়নি, কুরআনে অতি সামান্য একটি অংশ ইসলামের দাওয়াতী কাজ করার জন্য বর্তমান ছিল। তবু সেখানে যাদু ও সম্মোহনী শক্তির উৎস নিহিত ছিল। যার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তারা বলতে বাধ্য হয়েছে: (আরবী***************)
এতো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।
ওয়ালীদ বিন মুগিরা ইসলাম গ্রহণ করতে চেয়েও তা গ্রহণ না করার ঘটনাটি সূরা আল-মুদ্দাসসিরে বর্ণিত হয়েছে। অবতীর্ণের ধারাবাহিকতায় এ সূরার অবস্থান তৃতীয়। সূরা আলাক এবং সূরা আল-মুজ্জাম্মিল এর পুর্বে অবতীর্ণ হয়েছিল। আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব এ সূরাগুলো কিভাবে ওয়ালীদ বিন মুগরাকে প্রভাবিত করেছিল, এতে এমন কী যাদু ছিল যা তাকে পেরেশান করে তুলেছিল?
মক্কায় অবতীর্ণ ছোট ছোট এ সূরাগুলো যখন আমরা অধ্যয়ন করি তখন সেখানে শরয়ী কোন আইন কিংবা পার্থিব কোন ব্যাপার সামান্যতম ইঙ্গিতও পাই না। অবশ্যই সূরা ‘আলাকে মানব সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে সামান্য আলোচনা এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, মানুষকে জমাট বাধা রক্তপিন্ড থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া পরবর্তী বছরসমূহের ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছে। যেমন সূরা রূমে (পারস্য বিজয়ের ব্যাপারে) ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে ওয়ালীদ যেটিকে যাদু বললো, আল-কুরআনে তার শেষ কোথায়?
এর উত্তর হচ্ছে- ওয়ালীদ আল-কুরআনের যে অংশকে যাদু বলে আখ্যায়িত করেছে অবশ্যই তা শরয়ী আহকাম ও পার্থিব কোন জ্ঞানের বহির্ভূত বস্তু ছিল। আলোচনার এমন কোন বিষয় সেখানে ছিল না যে ব্যাপারে সে কোন কথা বলতে পারতো। অবশ্য একথাও ঠিক, ইসলামী আকীদা ও আধ্যাত্মিকতা অর্জনের প্রচেষ্টা ছাড়াই সে তার সূক্ষ্ম রহস্য হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছিল।
এ বার আসুন, সর্বপ্রথম অবতীর্ণ সূলা আল-‘আলাক সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখে। প্রথম ১৫টি আয়াতের দিকে সূক্ষ্মভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এর শব্দগুলো জাহিলি যুগের কবি ও সাহিত্যিকদের ব্যবহৃত শব্দের অনুরূপ, যার সাথে গোটা আরব পরিচিত ছিল কিন্তু তাদের লেখায় অনেক সামঞ্জস্যহীন শব্দ ও বাক্যের সমাবেশ ঘটতো। অনেক সময় তাদের সে রচনার মধ্যে কোন অন্তমিল ও প্রসঙ্গ পাওয়া যেত না। কিন্তু সূরা আলাকের ব্যাপারটি কি তেমন?
অবশ্যেই নয়। বরং সেখানে সামঞ্জস্য ও দ্যোতনার এক অপূর্ব সমাহার। প্রতিটি বক্তব্য উন্নত সাহিত্যের মূর্ত প্রতীক। অথচ তা একেবারেই প্রথম দিকে অবতীর্ণ আয়াত। সেখানে বলা হয়েছে ‘পড়ো’। তবে তা আল্লাহর পবিত্র ও সম্মানিত নামের সাথে হতে হবে। একরা বা পড়ো শব্দ দিযে উদ্দেশ্য হচ্ছে- আলকুরআন তিলাওয়াত বা অধ্যযন। এজন্যই আল্লাহর নাম নেয়ার প্রয়োজন যে, তিনি নিজের নামেরসাথেই দাওয়াত দেন। আল্লাহর এক সিফাতি নাম ‘রব্ব’। অর্থ প্রতিপালক। তাই তিনি প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণেরজন্য পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এ কথাগুলো আল্লাহর ভাষায়:
(আরবী***********)
পড়ো তোমার ঐ প্রতিপালকের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।
তখন ছিল ইসলামী দাওয়াতের সূচনাকাল। এজন্য রব্ব-এর বিশ্লেষণ হিসেবে এমন একটি শব্দকে বেছে নেয়া হয়েছে যা জীবন শুরুরসাথে চড়িত। অর্থাৎ তিনি একন ‘রব্বা’ (আরবী*****) যিনি সৃষ্টি করেছেন।’
(আরবী***********)-তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন ‘আলাক’ থেকে। অন্য কথায় তিনি মানুষের জীবন শুরু করেছেন জমাট বাধা রক্তপিণ্ড থেকে। কতো ছোট ও সাধারণ অবস্থা দিয়ে সূচনা।
কিন্তু আল্লাহ যেহেতু রব্ব বা প্রতিপালক হওয়ার সাথে সাথে তিনি খালিক (সৃষ্টিকর্তা) ও উঁচু স্তরের মেহেরবান। তাই ছোট্ট একটি মাংসপিণ্ডকে ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ এক মানষে রূপায়িত করেন। আর তার প্রকৃতি এমন, তাকে কোন কিছু শিখালে শেখার যোগ্যতা আছে। এজন্যই বলা হয়েছে:
(আরবী*************)
তুমি কুরআন পাঠ করো, তোমার প্রতিপালক অত্যন্ত দয়ালূ। তিনি হাতে কলমেশিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে (তা-ই) শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না। (সূরা আ’লাক: ৩০৫)
দেখুন একটি আয়াতে কতো সুন্দরভাবে মানুষের শুরু থেকে পূর্ণতার দিকে নেয়ার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝামাঝি সময়ের কথা একের পর এক বলা হয়েছে। যেন মানুষের চিন্তা ও সহজাত প্রবৃত্তি সেই দাওয়াতের প্রতি সাড়া দেয়।
বুদ্ধি-বিবেকের দাবি-ই ছিল এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা, কী সে ছিল এবং বর্তমান কোথায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এমনকি হয় না।
(আরবী************)
সত্যি সত্যি মানুষ সীমালংঘন করে, কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে (অর্থাৎ তার শুরু ও শেষের কথা ভুলে গেছে)। (আলাক: ৬-৭)
সে অহংকার ও দাম্ভিকতার বশে ভুলে গেছে বিধায় তাকে সতর্কতা ও ভর্ৎসনা মিশ্রিত বাক্যে সতর্ক করা হচ্ছে:
(আরবী***********)
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তাদেরকে তোমার প্রভুর দিকেই ফিরিয়ে আনা হবে। (সূরা আল-আলাক: ৮)
মানুষের বিদ্রোহ ও দাম্ভিকতার প্রসঙগ যখন চলছে তখন তাকে পরিপূর্ণ রূপদানের জন্য বলা হয়েছে। তারা শুধুমাত্র নিজেরাই বিদ্রোহী হয় না বরং অন্যদেরকেও বিদ্রোহী বানাবার প্রচেষ্টা করে। (আরবী***********)
তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছ, যে নিষেধ করে আল্লাহর এক বান্দাকে যখন সে নামাযে দাঁড়ায়। (সূরা আল আলাক: ৯-১০)
কোন ব্যক্তিকে নামায পড়তে বাধা দেয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ গর্হিত কাজটি তখনই বেশি বেড়ে যায় যখন নামাযী হেদায়েতের পথে অবিচল থাকেন এবং অন্যকে আল্লাহভীতি জাগ্রত করার চেষ্টা করেন।
(আরবী***********)
তুমি কি দেখেছ যদি সে সৎপথে থাকে অথবা আল্লাহভীতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। (সূরা আল-আলাক: ১৩)
চিন্তা করে দেখুন, মানুষ সবকিছু থেকে অসতর্ক। এমনকি কিভাবে তার জন্ম এবং কোথায় তার শেষ সে খবরটুকু তার নেই।
(আরবী************)
তুমি কি দেখেছ, যদি সে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে কি জানে, আল্লাহ সবকিছু দেখেন (সূরা আল-আলাক: ১৩-১৪)
অতঃপর তাদেরকে শাসানো হয়েছে: (আরবী*************)
কক্ষণ নয়। যদি সে বিরত না হয় তবে আমি তাকে মাথার চুলের গুচ্ছ ধরে হেঁচড়াবোই- মিথ্যাচারী, পাপীর কেশ গুচ্ছ। (আল আলাক: ১৫-১৬)
এখানে এমনভাবে শব্দ চয়ন করা হয়েছে যে, শব্দ নিজেই তার কাঠিন্যকে প্রকাশ করে দিয়েছে। যদি (****) এর স্থলে সমার্থবোধক শব্দ (****) নেয়া হতো তবে অর্থের দিকে এতো বেশি কাঠিন্য বুঝাতো না, যা (****) দ্বারা বুঝানো হয়েছে। এ শব্দ থেকে ধারণা হয়- এক ব্যক্তি কোন উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে শক্তভাবে কারো চুলের মুঠি ধরে রেখেছে আর সে দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। (*******) এ শব্দটির তাৎপর্য হচ্ছে, কোন বিদ্রোহী কিংবা অহংকারীকে উঁচু স্থান থেকে তার কপালের চুল ধরে হেচকা টানে ভূলুণ্ঠিত করে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া। টেনে হেঁচড়ে নেয়ার সময় অবশ্য সে নিজের সঙ্গী-সাথীদের নিকট চীৎকার কর সাহায্য চাইতে থাকে। যেমন আল্লাহ নিজেই বলেছেন: (আরবী*********)-অতএব সে তার সঙ্গী-সাথীকে আহ্বান করুক। আর (আরবী*******) আমি ডাকবো জাহান্নামের প্রহরীদেরকে।
একথা শুনে শ্রোতাদের ধারণা হয়, সম্ভবত জাহান্নামের পাইক-পেয়াদা এবং ঐ ব্যক্তির সাথীদের মধ্যে সেদিন সংঘর্ষ বেধে যাবে। এটি একটি কাল্পনিক চিত্র, যা কল্পনার জগতকে ছেয়ে ফেলে। রাসূল তাঁর নিজের অবস্থানে অটল থেকে রিসালাতের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। কেউ যদি তাঁর রিসালাতকে অস্বীকার কর মুখ ফিরিয়ে নেয় সেজন্য তিনি কোন পরওয়া করেন না। ইরশাদ হচ্ছে :
(আরবী*************)
কখনো তুমি তার কথায় প্রভাবিত হয়ো না, তুমি সিজদা করো ও আমার নৈকট্য অর্জন করো। (সূরা আল-আলাক: ১৯)
ইসলামী দাওয়াতের এ ছিল বলিষ্ঠ সূচনা। এ সূলার বাক্যগুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিওবা অবিন্যাসিত মনে হতে পারে কিন্তু এগুলো বিন্যাসিত ও পরস্পর সংশ্লিষ্ট। এ হচ্ছে আল-কুরআনের প্রথম সূরা যার বর্ণনা স্টাইলেই তাঁর অন্তরমিলের দিকটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবার অবতীর্ণের দিক থেকে দ্বিতীয় সূরাটির দিকে লক্ষ্য করুন যা সূরা আল-মুজ্জাম্মিল নামেপরিচিত। অবশ্য ‘সূরা ক্বলমের’ প্রথম দিকের আয়াতগুলো এর পূর্বে অবতীর্ণ হতে পারে। যাহোক ওয়ালীদ সূরা আল-মুজ্জাম্মিলের নিম্নোক্ত আয়াত ক’টি শুনেই কুরআনকে যাদু বলে ‘আখ্যায়িত করেছিল:
(আরবী****************)
যেদিন পৃথিবী ও পর্বতমালা প্রকম্পিত হবেএবং পর্বতসমূহ হয়ে যাবে বহমান বালুকা স্তুপ। আমি তোমাদের কাছে একজন রাসূলকে তোমাদের জন্য সাক্ষী করে পাঠিয়েছি যেমন পাঠিয়েছিলাম ফিরাউনের কাছে একজন রাসূল। ফিরাউন সেই রাসূলকে অস্বীকার করলো, ফলে আমি তাকে কঠিন শাস্তি দিলাম। অতএব, তোমরা কিভাবে আত্মরক্ষা করবে যদি সেদিনকে তোমরা অস্বীকার করো, যেদিন বালককে বৃদ্ধ বানিয়েদেবে। সেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে। তার প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। (সূরা আল-মুজ্জাম্মিল: ১৪-১৮)
উল্লেখিত আয়াতসমূহে কিয়ামতের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাই এমন এক ভয়ানক চিত্র যেখানে মানুষ কোন ছার গোটা সৃষ্টিলোকই তার আওতায় পড়ে যাবে। সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও ভারী হচ্ছে পৃথিবী ও পর্বতমালা। সেদিন সেগুলো কেঁপে উঠবে এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে এবং কাউকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা হবে না। শুধু তাদেরকেই গ্রেফতার করা হবে, যাদের নিকট রাসুল এসেছিলেন এবংতাঁর দাওয়াত পৌঁছেছে। সেই সাথে যাবতীয দলিল-প্রমাণও পূর্ণ হয়ে গেছে।
মক্কার কাফিরদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, তোমাদের জন্য যে রাসূল পাঠানো হয়েছে তিনি রাসূল হিসেবে নতুন ও প্রথম নন, তিনি তাদের মতোই একজন রাসূল, যাঁরা ফিরাউন ও তার মতো অন্যান্যদের নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন। আর তোমাদের শান-শওকত ও ক্ষমতা-ইখতিয়ার নিশ্চয়ই ফিরাউনের চেয়ে বেশিনয়। সে ফিরাউনকে পর্যন্ত কঠিন শাস্তি দেয়া হয়েছে। কাজেই তোমরাও কি চাও সেই রকম শাস্তিতে নিমজ্জিত হতে? যখন পৃথিবীর মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা যারা কুফুরীতে লিপ্ত আছ, তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে কিভাবে বাঁচবে? অথচ সেদিনের ভয়াবহতা দেখে দুশ্চিন্তায় শিশুরা পর্যন্ত বুড়ো হয়ে যাবে। আসমান ফেটে যাবে, পৃথিবী ও পাহাড় পর্বত কেঁপে উঠবে। এ ভয়ঙ্কর চিত্রের ভয়াবহতা থেকে কোন সৃষ্টিই নিরাপত থাকবে না। যখন কল্পনায় সেই বিভিষিকার চিত্র প্রতিফলিত হয় তখন কেউ প্রভাবিত না হয়ে পারে না। আর মানুষের অন্তরই এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহর এ ওয়াদা পুরো হবার মতোই একটি ওয়াদা। যা কার্যকরী হওয়ার ব্যাপারে কোন জায়গাও নেই। কাজেই বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে সময় থাকতেই আল্লাহর পথে চলে আসা। সেই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের রাস্তায় চলার চেয়ে আল্লাহর পথে ছলা অধিকতর সহজ।
হযরত উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে তিনি সূরা ত্ব-হা’র প্রথমদিকে কিছু আয়াত পড়ে বা শুনে ইসলামের দিকে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সূরা ত্বা-হা ছিল অবতীর্ণেল ক্রমানুসারে ৪৫ নং সূরা। এর পূর্বে যে সমস্ত সূরা অবতীর্ণ হয়েছিল তা নিচে পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা হলো:
(১) সূরা আল-আলাক
(২) সূরা আল-মুজ্জাম্মিল
(৩) সূরা আল-মুদ্দাস্সির
(৪) সূরা আল-কলম
(৫) সূরা আল-ফাতিহা
(৬) সূরা আল-লাহাব
(৭) সূরা আল-তাকভীর
(৮) সূরা আল-আ’লা
(৯) সূরা আল-লাইল
(১০) সূরা আল-ফজর
(১১) সূরা আল-দোহা
(১২) সূরা আল-ইনশিরাহ
(১‘৩) সূরা আল-আসর
(১৪) সূরা আল-আদিয়াহ
(১৫) সূরা আল-কাওসার
(১৬) সূরা আল-তাকাসুর
(১৭) সূরা আল-মাউন
(১৮) সূরা আল-কাফিরূন
(১৯) সূরা আল-ফীল
(২০) সূরা আল-ফালাক
(২১) সূরা আন-নাস
(২২) সূরা আল-ইখলাস
(২৩) সূরা আন-নাজম
(২৪) সূরা-আবাসা
(২৫) সূরা আল-কাদর
(২৬) সূরা আশ-শামস
(২৭) সূরা আল-বুরুজ
(২৮) সূরা আল-তীন
(২৯) সূরা আল-কুরাইশ
(৩০) সূরা আল-ক্বারিয়াহ
(৩১) সূরা আল-কিয়ামাহ
(৩২) সূরা আল-হুমাযা
(৩৩) সূরা আল-মুরসালাত
(৩৪) সূরা -ক্বাফ
(৩৫) সূরা আল-বালাদ
(৩৬) সূরা আত-তারিক
(৩৭) সূরা আল-ক্বামার
(৩৯) সূরা আল-আ’রাফ
(৪০) সূরা আল-জ্বিন
(৪১) সূরা ইয়াসীন
(৪২) সূরা আল-ফুরকান
(৪৩) সূরা আল-ফাতির
(৪৪) সূরা আল-মারইয়াম
(৪৫) সূরা আল-ত্বা-হা[বাকী সূরাগুলো অবতীর্ণ ক্রমের তালিকা পরিশিষ্ট-২ দ্রষ্টব্য। -অনুবাদক]
উপরোল্লেখিত সমস্ত সূরাই মক্কায় অবতীর্ণ। অবশ্য এ সূরাগুলো মধ্যে কিছু কিছু আয়াত মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। আসুন এবার আমরা উল্লেখিত সূরাসমূহের ওপর সাধারণভাবে একটু নজর বুলিয়ে নেই; যেভাবে আমরা ওয়ালীদের ঘটনাটি পর্যালোচনা করেছি, সেভাবে এ সূরাগুলো পর্যালোচনা করা এখানে সম্ভবপর নয়। আমরা শুধু একটুকু আলোচনা করতে চাই, সূরাগুলোর মধ্যে এমন কিযাদু নিহিত আছে যার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পূর্ববর্তীগণ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তখনতো উমর (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের জন্য ইসলামের শক্তি বেড়ে যায়নি কিংবা ইসলাম বিজয়ী অবস্থায়ও ছিল না।
এ সূরাগুলোকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিশেষজ্ঞগণ কুরআনের মর্যাদা ও মাহাত্ব্য বুঝাতে যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার বেশির ভাগ বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচ্য সূরাগুলোতে অনুপস্থিত। যদি ধরে নেয়া হয়, সূরা আল-ফাতিরে মানুষের সৃষ্টি রহস্যের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং সূরা আত্ তারিকেও অনুরূপ আলোচনা এসেছে। তবু একথা মেনে নিতে হবে, পার্থিব বিষয়ের আলোচনা সেখানে আসেনি এবং সেখানে শরীয় কোন বিধানের নাম-গন্ধও নেই। কিন্তু এ সত্য প্রতিষ্ঠিত যে, আলোচ্য সূরাগুলো ছাড়া অবশিষ্ট সূরা সমূহে এসব বিষয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় আলোচনা এসেছে। চাই তা মক্কী সূরা হোক কিংবা মাদানী।
আমরাচাই কিছু সময়ের জন্য হলেও (কুরআনে কারীমের দ্বীনের পবিত্রতা, ইসলামের দাওয়াতের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে) স্থান-কাল ও পত্রের উর্ধ্বে ওঠে কুরআনে কারীমের সেই শৈল্পিক সৌন্দর্য ও রহস্য অনুধাবনের চেষ্টা করতে যা মৌলিক নীতির মর্যাদা রাখে। যা কুরআনের মতোই শাশ্বত ও চিরন্তনী। শৈল্পিক এ সৌন্দর্য আল কুরআনকে অন্য সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী করে দেয়। ফলে দ্বীনি গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে ধাবিত হয় মনজিলে মাকসুদের দিকে।
এবার দেখা যাক আজ পর্যন্ত মানুষ কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে আল কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্যকে দেখে আসছে।