al_quraner_shoilpik_soundorjo

বারো অধ্যায়

প্রজ্ঞা-প্রসূত যুক্তি

অন্যান্য দাওয়াতকে যেমন বিভিন্নভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, তেমনিভাবে ইসলামী দাওয়াতকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। যারা ইসলামের দাওয়াতকে অসার প্রমাণের জন্য যুক্তি-তর্কের অবতারণা করেছে ইসলামও তাদেরকে যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। কেননা কুরআন মূলত ইসলামী দাওয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট, এজন্য সেখানে যুক্তি-প্রমাণও বর্তমান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কুরআনী যুক্তির ধরন কি? বা সেই যুক্তি-তর্কের জন্য কি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে এবং সেজন্য কি কি দলির-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে?

এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে আমাদের দেখা উচি, কুরআন কেন এসেছে? এবং তা অবতীর্ণের উদ্দেশ্য কি?

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল-কুরআন সবচেয়ে বড় আকীদা-তওহীদের আকীদা- পুনরুজ্জীবন ও পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য এসেছে। এমন একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ আকীদাকে পুনর্জীবিত করা উদ্দেশ্য ছিল, যারা আল্লাহর সাথে অন্যদেরকেও অংশীদার মনে করতো। কাজেই তাদেরজন্য এর চেয়ে আশ্চর্যের কথা আর কিছুই ছিল না যে, কোন ব্যক্তি বলবে আল্লাহ এক।

(আরবী*********)

সে কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে একজনের উপাসনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? নিশ্চয়ই এ একটি বিস্ময়কর ব্যাপর। তাদের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি একথা বলে প্রস্থান করলো, তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের উপাস্যদেরআরাধনা করতে থাক। অবশ্যই এ বক্তব্য কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আমরা ইতোপূর্বে এমন আজব কথা আর শুনিনি। এটি মনগড়া ব্যাপর বৈ আর কিছুই নয়। (সূরা সাদ:৫-৭)

বর্তমানেআমরা যখন মুশরিকদের এসব কথাবার্তা ও চিন্তা-ভাবনার প্রতি লক্ষ্য করি তখন আমাদের হাসি পায়। আমাদের কাছে তাদের একথা সাংঘাতিক বোকামী মনে হয়। কিন্তু আমদের দেখতে হবে ঐ সময়ে তওহীদ সম্পর্কে সাধারণের ধারণা কি ছিল?

এতে কোন সন্দেহ নেই, তখন তওহীদের আকীদা ভীষণ আশ্চর্যের দৃষ্টিতে দেখা হতো।

আরেকটি কথা বুঝে নেয়া দরকার, আল-কুরআন আরবের যেসব লোককে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য পেশ করেছে তাদের সবাই মুশরিক ছিল না। সেখানে আহলে কিতাব (পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারী) লোকও ছিল। কিন্তু তারা পছন্দ করতো না, অন্য কোন দ্বীন এসে তাদের দ্বীনকে মিটিয়ে দিক। অথবা আসমানী কিতাব এমন এক ব্যক্তির ওপর নাযিল হোক যিনি তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে নন। সেই নতুন দ্বীনের মূলনীতি ও সম্পর্ক তাদের দ্বীনের সাথে যতোই থাকুক না কেন।

(আরবী*********)

এবং তারা প্রথম কাফিরদের ওপর বিজয় প্রার্থনা করতো। যাকে তারা উত্তমরূপে জানতো যখন সে তাদের কাছে পৌঁছল তখন তারা তাকে অস্বীকার করে বসলো। (সূরা আল-বাকারা: ৮৯)

একটি কথা ভেবে দেখার মতো, ইসলাম দ্বীনি ভিত্তি ও মূলনীতির দিক থেকে আহলে কিতাবদের সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল। (কেননা বিকৃতির পূর্বে সেটিও ইসলাম ছিল) কিন্তু তখন ইহুদী ও খ্রস্টানদের আকীদা যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছিল, ইসলাম তাকে মোটেও বরদাশত করতে রাজী ছিল না। ইহুদীরা হযরত উজাইর (আ)-কে আল্লাহর পুত্র বানিয়ে নিয়েছিল আর খ্রীস্টানরা ঈসা (আ)-কে। তাই ইহুদী ও খ্রীস্টানদের দাবি ছিল আমরা আল্লাহর পুত্র এবং আমরা আল্লাহর নিকটতম ও স্নেহভাজন। আমাদের যদি জাহান্নামে যেতেই হয় তবে তা সামান্য কয়েকদিনের জন্য মাত্র। যে কথা স্বয়ং কুরআন বিভিন্নজায়গায় বলে দিয়েছে।

উপরোক্ত অবস্থার আলোকে বলা যেতে পারে, ইসলাম তওহীদী আকীদাকে পুনর্জীবিত করার জন্য যে আহ্বান জানিয়েছিল তা ইহুদী ও খ্রীস্টানদের জন্য অশ্রুতপূর্ব এক কথা ছিল। উপরন্তু আল-কুরআনের প্রথম দাবি ছিল বড় আকীদা (অর্থাৎ তওহীদী আকীদা)-কে নতুন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে তাকে পুনর্জীবন দান করা।

আমরা তওহীদী আকীদাকে সবচেয়ে বড় আকীদা বলেছি (যদিও বর্তমানে আমাদের কাছে এটি আশ্চর্যের কোন বিষয়ই নয়। এটি এক স্বতসিদ্ধ ব্যাপার) কারণ পূর্ব পুরুষ থেকে চলে আসা আকীদা-বিশ্বাসকে সরাসরি পরিত্যাগ করা কোন মানুষের জন্য চাট্টিখানি কথা ছিল না। আকীদা শৈশব থেকে মানব প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এবং মানুসের জীবনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য হাজারো ঘটনা চিন্তা ও চেতনাকে মুছে ফেলে দিয়ে একজন ইলাহ্‌র দিকে ছুটে চলে আসবে (যিনিতার যাবতীয় দৈহিক ও মানসিক শক্তির ওপর বিজয়ী) এটি সহজ ছিল না।

সত্যি কথা বলতে কি, ইসলামই প্রথম দ্বীন নয়, যে তওহীদের দাওয়াত দেয়। অন্যান্য ধর্মও তওহীদের দাওয়াত দেয় এবং সেইসব ধর্মকেও তওহীদের দাওয়ারেত কারণে বিপদাপদ ও দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, ইসলামও এরূপ দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। অবশ্য পার্থক্য এই যে, ইসলাম যে তওহীদের দাওয়াত দেয় তা সম্পূর্ণরূপে শির্‌ক মুক্ত। এমনকি শিরকের সংশয় থেকেও তা পবিত্র ও মুক্ত। এটি নির্ভেজাল তওহীদ। মানবসত্তার মধ্যে রূপ বা সাকারের যে ক্ষুদ্রতম জীবাণু পাওয়া যায়, ইসলাম তারও সম্পূর্ণ বিরোধী।

উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে বুঝা যায় কুরআনের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হচ্ছে তওহীদের নির্ভেজাল ও পবিত্র আকীদাকে সমুজ্জ্বল করা। উল্লেখ্য যে, আকীদা বা চেতনার স্থায়ী কেন্দ্র হচ্ছে মানুষের মন ও বিবেক। শুধু দ্বীনি আকীদাই নয় বরং সমস্ত আকীদারই আসল জায়গার মানুষের মন। মনের দিকে নিকটতর রাস্তা প্রত্যুৎপন্নমতিরত্ব। (অর্থাৎ যে কথা স্বতঃসিদ্ধ ও সহভাবে উপস্থাপন করা হয় মন তা গ্রহণ করে) এবং বিবেক পর্যন্ত পৌঁছানেরসহজতর পথ হচ্ছে উপলব্ধি বা অনুভূতি। (অর্থাৎ অনুভূতির মাধ্যমে বিবেক প্রভাবিত হয়)। এ বিষয়ে মেধার অবস্থান একটি সংযোগ নালীল চেয়ে বেশি নয়। মেধা একটি সুরঙ্গ। এ সুরঙ্গ ছাড়া আরও অনেক সুরঙ্গ আছে। এই যে মেধা তা সমস্ত সুরঙ্গের চেয়ে প্রশস্ত নয় এবং নির্ভরযোগ্যও নয়। আবার মেধা এমন সুরঙ্গ নয় যা অন্যান্য সুরঙ্গের চেযে নিকটতর। বস্তুত মেধার এমন কোন বিশেষত্ব নেই যা মন ও বিবেককে পৃথক করে দিতে পারে।

অধুনা কিছু লোক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি দেখে মানুষের মেধা ও যোগ্যতাকে অত্যন্তগুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি কতিপয় মোটা বুদ্ধির দ্বীনদার লোক পর্যন্ত এই ফিতনায়জড়িযে গিয়ে দ্বীনি দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনাকেমস্তিষ্কপ্রসূত যুক্তি-তর্ক এবং বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরে যাচাইয়ের চেষ্টা করে। এসব লোক মারাত্মক ভুলের মধ্যে রয়েছে।

এ লোকগুলোমানুষের জ্ঞান বুদ্ধিকে এতোটা প্রাধান্য দিচ্ছে, যা মোটেই তার প্রাপ্য নয়। একে ততোটুকু মর্যাদাই দেয়া উচিত যতোটুকু মর্যাদা তার প্রাপ্য। একথার অর্থ এই নয় যে, ইসলাম মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধিকে ছোট করে দেখে। মানুষের জ্ঞানের পরিদি অনেক বিস্তৃত। তবও জ্ঞান ও জানার পরিধিকে সে পুরোপুরি আয়ত্ব করতে পারে না। তা বুদ্ধিবৃত্তিক হোক কিংবা অনুভূতিগত। তাছাড়া মানুষের মেধা ও বুদ্ধি তার অসংখ্য সুরঙ্গ পথের মধ্যে একটি পথের চেয়ে বেশি নয়। একজন মানুষ সেই সুরঙ্গ পথকে নিজের জন্য তখনই বন্ধ করতে পারে, যখন তার আত্মা দুর্বলতার শিকার হয় এবং তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। এজন্য এ মহান কাজে সিদ্ধান্ত নেয়ার সামর্থ থেকে সে বঞ্চিত হয়ে যায়।

অবশ্য একটা ঠিক যে, মেধা দৈনন্দিন জীবনের কাজ ও প্রয়োজনসমূহ পরিচালনা করে। উপরন্তু সেসব সমস্যার মধ্যেও অনুপ্রবেশ করে যা কোন না কোন ভাবে মানব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু যেখানে আকীদা-বিশ্বাসের প্রশ্ন জড়িত তার মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। মানুষের চিন্তা সেটির শেষ সীমার উপনীত হতে পারে না। আকাইদের চূঁড়ায় কেবল সেই ব্যক্তি পৌঁছতে পারে যে হেদায়েতের পথে আছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী। বস্তুত এ প্রকৃতির লোকই নিজের অন্তর ও অনুভূতিকে হেদায়েতের নূরে আলেকিত করতে পারে।

সকল ধর্মে সর্বদা সেইসব লোক-ই বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরেছে যারা হেদায়েত ও অন্তর্দৃষ্টির পথের যাত্রী। যুক্তিবাদীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী তওহীদী আকীদার ব্যাপারে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে লিপ্ত রয়েছে কিন্তু বিনিময়ে তাদের কিছুই অর্জিত হয়নি। কুরআনে কারীমা মাত্র ক’ বছরে যা কিছু দেখিয়েছে যুক্তিবিদ্যার পণ্ডিতগণ তার সহস্র ভাগের একভাগও করতে পারেনি। আসুন দেকি আল-কুরআন সেই উদ্দেশ্য কি ধরনের সহজ ও সাধারণের বোধগম্য পথ অবলম্বন করেছে।

আল-কুরআনের সহজ-সরল বক্তব্য

মানুষের অন্তর্দৃষ্টিকে শানিত করার জন্য আল-কুরআন সর্বদা মানুষের চেতনা ও অনুভূতিকে জাগ্রত করার চেষ্টা করে। আরেকটু আগে বেড়ে সে মানুষের বিবেকেকে প্রভাবিত করতে চায়। এ উদ্দেশ্যে কুরআন যা করতে চায় তা দৃশ্যের বোধগম্যতা এবং দৃষ্টিগোচরের সাথে সংশ্লিষ্ট। অন্য কথায় তর্কে পরিণত শিল্পকর্মও বলা যেতে পারে। আল-কুরআন সেসব স্বতসিদ্ধ বাস্তবতার মাধ্যমেও কাজ নিয়ে থাকে, যা চিরন্তনী ও স্থায়ী। তা এমন বাস্তব, যার জন্য অন্তর্দৃষ্টির আলোকময় দরোজা খুলে যায় এবং সে সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা তা উপলব্ধি করে।

এজন্য আল-কুরআন যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, তাসাধারণ এক পদ্ধতি- কল্পনা ও রূপায়নের মাধ্যমে কোনবস্তুকে সচিত্র উপস্থাপন করা- যেমন আমরা বিগত অধ্যায়ে এ সম্পর্কে আলোকপত করেছি। এখানে আমরা ‘তাজসীম’ (রূপায়ণ) শব্দটি শৈল্পিক ভাব প্রকাশক অর্থে ব্যবহারকরেছি, দ্বীনি অর্থে নয়। কেননা ইসলাম বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণা মুক্ত পবিত্র দ্বীন, তা রূপায়নের মুখাপেক্ষী নয়।

আল-কুরআন যে পদ্ধতিতে বিরোধীদের যুক্ত-প্রমাণ উপস্থাপন করে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করেছে তাকে আমরা প্রজ্ঞা প্রসূত যুক্তি বলতে পরি। আর এ যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে কখনো শব্দ দিয়ে,কখনো বিভিন্ন কিস্‌সা-কাহিনী দিয়ে, আবার কখনো ছবির মাধ্যমে। এ সবকিছুর সমন্বয়েই কুরআন তার উদ্দেশ্য পূর্ণকরেছে। ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।

তাছাড়া কিয়ামতের যেদৃশ্য প্রদর্শন করা হয়েছে, শান্তি ও শাস্তির যে ছবি আঁকা হয়েছে, তাও প্রজ্ঞাপ্রসূত যুক্তির অন্তর্ভুক্ত। এগুলো মানুষের অবচেতন মনের দুয়ারে কষাঘাত করে। চিন্তাকে করে শাণিত, অন্তর্দৃষ্টিকে করে প্রসারিত। অলস স্বপ্ন থেকে জাগ্রত করেবাস্তব জগতে নিয়ে আসে মানুষকে। ফলে মানুষেরমন সত্যকে গ্রহণ করার ও তার ওপর দৃঢ় থাকার জন্য তৈরী হয়ে যায়।

উপরন্তু আল-কুরআন মানবিক ও মনোজাগতিক চিত্র, কিস্‌সা-কাহিনী, কিয়ামতের দৃশ্য, শাস্তি ও শান্তির চিত্র ছাড়াও দাওয়াতকে গ্রহণযোগ্যকরার জন্য আরেকটি পন্থা অবলম্বন করেছে, তা হচ্ছে প্রজ্ঞাপ্রসূত যুক্তিকে ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা। এজন্যআমি একে পৃথক অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তবে এ অধ্যায়ে আলোচনার বিষয যুক্তি-তর্ক নয়। আমরা কেবল আলোচনাকরতে চাই সেই যুক্তি-প্রমাণের ধরন বা প্রকৃতি কি? কারণ, আমাদের মূল আলোচনা হচ্ছে- ছবির প্রকৃতি ও ধরন নিয়ে, যার ওপর ভিত্তিকরে কুরআনের অব্যাহত চলা। কেননা আমারে এ পুস্তকের বিষয়বস্তু শুধু আল-কুরানের শৈল্পিক দিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্য কিছু নয়। আল-কুরআনের অন্যান্য বিষয়ের আলোচনা আমাদের উদ্দেশ্যই নয়।

তওহীদ (একত্ববাদ) সমস্যা

আমরা পূর্বেই বলেছি, ইসলামের প্রথম দাওয়াত ও দাবিই হচ্ছে তওহীদ। কুরআন যাদেরকে সম্বোধন করেছে তারা ছিল তওহীরে ঘোর বিরোধী। তারা একে আজব কথা মনে করতো। দেখার বিষয় হচ্ছে তওহীদ অস্বীকারকারীদের সাথেকুরআন কিভাবে তার যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেছে

এতে কোন সন্দেহ নেই, আল-কুরআন তওহীরে দাওয়াতকে অত্যন্ত সহজ ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় পেশ করে মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়ার চেষ্টা করেছে। আল-কুরআনের বক্তব্য এমন স্বতঃসিদ্ধ ও সুস্পষ্ট যার মধ্যে না আছে কোনজটিলতা আর না আছে পাল্টা যুক্তির অবকাশ। ইরশাদ হচ্ছে:

(আরবী***********)

তারা কি মাটির তৈরী মূর্তিকে ইলাহ্‌ হিসেবে গ্রহণ করেছ এজন্য যে, তারা তাদেরকে জীবিত করবে? যদি আকাশ পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ থাকত, তবে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যেত। তাই তারা যা বলে তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র। তিন যা কনে সে সম্পর্কে তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন না বরং তাদেরকে জিজ্ঞেসকরা হবে। তারা কি আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্য গ্রহণকরেছে? বলো: তোমরা তোমাদের প্রমাণ আন, এটাই আমার সঙ্গীদেরকথা এবং এটিই আমার পূর্ববর্তীদের কথা। বরং তাদের অধিকাংশই সত্য জানে না, ফলে টালবাহানা করে। (সূরা আল-আম্বিয়া: ২১-২৪)

(আরবী***********)

আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সাথে কোন ইলাহ নেই। থাকলে প্রত্যেকে নিজ নিজ ‍সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেত এবং একজন আরেকজনের ওপর জড়াও হতো। কাজেই তারা যা বরে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র। (সূরা আল-মু’মিনুন:” ৯ ১)

তওহীদের স্বপক্ষে এ রকম স্বতঃসিদ্ধ ও সুস্পষ্ট প্রমাণ আরও অনেক আছে। এ আয়াতগুলোর তাৎপর্য হচ্ছে, আমরা পৃথিবী ও আকাশের কোন রকম বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় দেখি না। সবকিছু সুষ্ঠুভাবে চলছে। এতেই বুঝা যায় বিশাল সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপনা শুধু একজনেরই হাতে। আর তিনি হচ্ছেন সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।

সাথে সাথে কুরআন একথাও বলে দিয়েছে, যদি আসমান-জমিনে একাধিক ইলাহ্‌ থাকতো তবে তারা যার যার সৃষ্টি নিয়ে পৃথকহযে যেতো। এতো অত্যন্ত হাসির কথা, প্রত্যেক সৃষ্টি তার ইলাহরকাছে আশ্রয় নেবে। তারপর প্রত্যেক ইলাহ তার সৃষ্টি নিয়ে পৃথকভাবে চলতে থাকবে। কিন্তু জানা নেই, সেচলার শেষ কোথায? আমাদের কাছেও এর কোন জবাব নেই। তাই একাধিক ইলাহর কথা স্মরণ হলেই আমাদের হাসি পায়, যদি একাধিক ইলাহ থাকতো তবে আসামন-জমিনে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতো।

আরও প্রশ্ন হতে পারে, যদি আরেকজন ইলাহ্‌ থেকেই থাকেন তিনি কি করেছেন? আসমান আরজমিন তো সৃষ্টি করা হয়েই গেছে এবং তা আমাদের সামনে মওজুদ আছে। তিনি নতুন করে কি সৃষ্টি করেছেন?

(আরবী***********)

বলো: তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর যাদের পূজা করো তাদের বিষযে ভেবে দেখেছ কি? দেখাও তো আমাকে তারা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে? অথবা নভোমণ্ডল ‍সৃষ্টিতে তাদের কি কোন অংশ আছে? এর পূরবর্তী কোন কিতাব কিংবা পরম্পরাগত কোন জ্ঞান আমার সামনে উপস্থিত করো, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। (সূরা আহকাফ: ৪)

আবার দেখুন, বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহর সৃষ্টি বিদ্যমান। আল্লাহর কুদরতের স্পর্শ প্রতিটি জায়গায়, প্রতিটি বস্তুকে প্রকাশমান। আমাদের ইন্দ্রিয় তা দেখে, বিবেক তার স্বীকৃতি দেয়, অন্তর্দৃষ্টি তা অনুভব করে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে:

(আরবী***********)

বলো: সকল প্রশংসা আল্লাহর এবং শান্তি তার মনোনীত বান্দাদের ওপর। শ্রেষ্ঠ কে? আল্লাহ না ওরা, তারা যাদেকে শরীক সাব্যস্ত করে? বলতো কে সৃষ্টি করেছেন নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল? আকাশ থেকে কে তোমাদের জন্য পানি বর্ষণ করেছেন?(অবশ্যই আমি তা বর্ষণ করি) অতপর সেই পানি দিয়ে আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার শক্তিও তোমাদর নেই। অতএব, আল্লাহর সাথ অন্য কোন সৃষ্টিকর্তা আছে কি? সত্যিকথা বলতে কি, তারা বিচ্যুতসম্প্রদায়। বঃলতো কে পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন এবং তারমাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন? এবং তাকে স্থির রাখার জন্য পাহাড়-পর্বত স্থাপন করেছেন আর সমুদ্রের মাঝে আড় দিয়ে রেখেছেন? এবার বলো,তাঁর সাথে কোন উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না। বলতো কে নঃসহায়ের ডাকে সাড়া দেন? যখন সে ডাকে। এবং কষ্ট দূরীভূত করেন আর তোমাদেরকে পৃথিবীতে পুনর্বাসিত করেন। সুতরাং আল্লাহর সাথে কোন ইলাহ আছে কি? তোমরা খুব সামান্যই চিন্তা করো। বলতো কে তোমাদেরকে জলে-স্থলে ও অন্ধকারে পথ দেখান? এবং তিনি তাঁর অনুগ্রহের পূর্বে সংবাদবাহী বাতাস প্রেরণ করেন? কাজেইআল্লাহর সাথে আর কোন উপাস্য আছে কি? তারা যাদেরকে শরীক করে তা থেকে আল্লাহ অনেক ঊর্ধ্বে। বলতো কে প্রথমবার সৃষ্টি করেন অতপর তাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন এবং কে তোমাদেরকে আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিযিক দান করেন? (আবার বলো) আল্লাহর সাথে আর কোন ইলাহ আছে কি? বলো: যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত করা। (সূরা আন-নামল: ৫৯-৬৪)

উল্লেখিত আয়াতসমূহের বিভিন্ন বিষয় মানব সত্তায় তওহীদী চেতনাকে মজবুত ও দৃঢ় করতে একে-অপরের অংশীদার, পরিপূরক। যেমন আসমান-জমিনের দৃশ্যাবলী দৈনন্দিন জীবনে সংঘটিত নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা, প্রকৃতিগত অনুভূতি যা জীবিকারকষ্টেমানুষকে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ার জন্য বাধ্য করে। এসব কিছু মিলে চিন্তা, অনুভূতি, বিবেক এবং অন্তর্দৃষ্টিকে প্রভাবিত করে মানব-সত্তাকে তওহীদী চেতনার দিকে ধাবিত করে। এ ধরনের আয়াত আল-কুরআনে অসংখ্য। তদ্রূপকিয়ামত,জান্নাত এবংজাহান্নামের দৃশ্যাবলীও আল-কুরআনে কম নয়। তেমনিভাবে তওহীদের আকীদা (চেতনা)-কে মানুষের মন-মগজে বদ্ধমূল করার আয়াতেরও কোন ঘাটতি নেই। এসব কিছুই মূলত প্রজ্ঞা-প্রসূত যুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এই অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

মৃত্যুর পর পুনরুত্থান

যে দাবিটি বুঝাতে ইসলামের সবচেয়েবেশি কষ্ট হয়, সেটি হচ্ছে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান, কিয়ামত, হাশর ইত্যাদি। ইসলাম সেইসব আরবকে উদ্দেশ্য করে বলেছে যারা বলেছিল:

(আরবী***********)

আমাদের পার্থিব জীবনই একমাত্র জীবন। আমরা মরি কিংবা বাঁচি সব এখানেই এবং আমরা কখনো পুনরুত্থিত হবো না। (সূরা মুমিনুন: ৩৭)

পুনরুত্থানের বিষয়টি আরবদের মধ্যে তওহীদের দাওয়াতের চেয়েও বেশি আশ্চর্যের বিষয় ছিল। যারা পুনরুত্থানর বিষয়টিকে মেনে নিত তাদেরকে তারা পাগল বলতো। তাদের ধারণা ছিল কোন সুস্থ মস্তিষ্কের লোক একথা মেনেনিতে পারে না।

কাফিররা বলতো: আমরা কি তোমাদেরকে এমন ব্যক্তিরসন্ধান দেব না, যে খবর দেয় তোমরাসম্পূর্ণ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে? সে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যে বলে, না হয় পাগল? (সূরা আস্‌-সাবা: ৭-৮)

হাশর-নশরকে তারা এরূপ আশ্চর্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতো। এবার দেখা যাক এমন আশ্চর্যজনক পরিস্থিতিতে আল-কুরআন তাদের সামনে কি ধরনের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করেছে।

কুরআনতাদেরকে সৃষ্টির প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেশকরেছে। জমিনে বিশেষ করে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করে মানুষকে এক বিশেষ জীবন প্রদানের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এখানে কুরআনের উদ্দেশ্য ছিল- আল্লাহ যেমন সৃষ্টির সূচনা করতে পারেন, আবার তিনি তার পুনরাবৃত্তিওকরতে পারেন এবং তিনি এ ব্যাপারে সক্ষম।

(আরবী***********) আমিকি প্রথমবার সৃষ্টি করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি? বরংতারা নতুন সৃষ্টির ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছে (সূরা ক্বাফ: ১৫)

আল-কুরআনের চিত্রায়ণ পদ্ধতিতে যা কুরআনের একটি বিশেষ প্রকাশ ভঙ্গি জমিন ও মানুষের মধ্যে জীবনের যে সাদৃশ্য পাওয়া যায় সেই বিশেষ ভঙ্গিতে তা প্রকাশ করেছে।

(আরবী***********)

মানুষ ধ্বংস হোক, সে কতো অকৃতজ্ঞ! তিনি তাকে কি বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন? বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর তাকে সুপরিমিত করেছেন। অতপর তার পথ সহজ করেছেন, তারপর তার মৃত্যু ঘটা ও কবরস্থ করেন। এরপর যখন ইচ্ছে করবেন তাকে পুনরায় জীবিত করবেন। সেকখনো কৃতজ্ঞ হয়নি, তিনি তাকে যা আদেশকরেছেন সে তা পূর্ণ করেনি। মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমি অলৌকিকভাবে তাতে পানি বর্ষণ করেছি, তারপর আমি ভূমিকে বিদীর্ণ করেছিতারপর সেখানে উৎপন্ন করেছি শষ্য, আঙ্গুর, শাক-সব্জি, যয়তুন, খেজুর, ঘনোবাগান, ফল এবং ঘাস। তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ প্রাণীদের উপকারার্থে। (সূরা আব্বাসা: ১৭-৩২)

অন্যত্র বলা হয়েছে:

(আরবী***********)

তিনি মৃত থেকে জীবিত এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন আর মৃত জমিনকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এভাবে তোমাদেরকে পুনরুত্থিতকরা হবে। তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন হচ্ছে, তিনি মাটি থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, এখন তোমরা (মানুষ), পৃথিবীতে ছড়িযে আছ। আরেক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্যে থেকে একজন সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ করতে পার এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টিকরে দিযেছেন। অবশ্যই এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন আছে। তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষিট এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র! নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন আছে। তাঁর আরও একটি নিদর্শন এই যে, রাতে ও দিনে তোমাদের নিদ্রা এবং তাঁর কৃপা অন্বেষণ। নিশ্চয়ই এতে যারা মনোযোগী তাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। তাঁর আরেক নিদর্শন থেকে পানি বর্ষণ করেন, তারপর তা দিয়ে মৃত জমিনকে জীবিত করেন। নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমান লোকদেরজন্য নিদর্শন রয়েছে। (সূরা আর রুম: ১৯-২৪)

কুরআন তাদের সামনে এমন কিছু ছবি উপস্থিত করেছে যা তাদের বোধগম্য এবং যে সম্পর্কে তারা ভালোভাবে অবগত। তাদের ইন্দ্রিয় সারাক্ষণ এসব চিত্র অবলোকন করতো। এসব ছবি তাদের জ্ঞান-বুদ্ধিকে প্রতিনিয়ত তার (শিক্সার) দিকে টানত।

এসব দৃশ্যাবলী আরবদের জীবন-জীবিকা এবং তাদের বিবেক ও অনুভূতির সাথে গভীর সম্পর্ক রাখতো। এদৃশ্যগুলো তাদের সত্তায় একাকার হয়ে গিয়েছিল। কুরআন তাদেরকে সেসব দৃশ্যের দিকে এমনভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে মনে হয় তা কোন নতুন দৃশ্য। অবশ্য যে ব্যক্তি চোখ-কান খোলা রেখে সেসব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সে নিশ্চয়ই সেখানে নতুনত্বের সন্ধান পায়- যদি সে নিজের জিদের ওপর প্রতিষ্ঠিত না থাকে। মস্তিষ্ট প্রসূস যুক্তির কোন স্থায়ীত্ব নেই, বড়জোর তা নৈপুণ্যতার দলিল হতে পারে।

মানুষের মেধা বা ইন্দ্রিয় উভয়ে এটি চায় যে, আকীদা (চেতনা)-এর গভীর পর্যন্ত সে পৌঁছে যাক। মানুষ অজানা বিষয়ে জানতে আগ্রহী। কোন আকীদা চেতনা ও অনুভূতি থেকে যতোটুকু গোপন ও দূরে থাকে, সেই পর্যন্ত পৌঁছতে তা আকাংখিত হয়্ এজন্য ‍কুরআন আকীদার ব্যাপারেও ছবি ও কল্পনার স্টাইলে বর্ণনা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।

(আরবী***********)

তুমি কি দেখ না, আকাশ ও পৃথিবীতে যা আছে এবং উড়ন্ত পাখীগুলো তাদের পাখা বিস্তার করে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই তার যোগ্য ইবাদত, পবিত্রতা এবং মহিমা ঘোষণার পদ্ধতি জানে। (সূরা আন-নূর:৪১)

সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সবই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। এমন কিছু নেই, যা তা৭র মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের সে মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৪৪)

(আরবী***********)

যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করে। তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনাকরে এই বলে: হে আমাদের পালনকর্তা, আপনার রহমত ও জ্ঞান সবকিছুতেই পরিব্যপ্ত। অতএব, যারা তওবা করে এবং আপনার পথে চলার, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবংজাহান্নামের আযাব থেকে রক্সা কুন। হে আমাদের পালনকর্তা, তাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করান, যার ওয়াদা আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের বাপ-দাদা, পতি-পত্নী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করে তাদেরকে। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আর আপনি তাদেরকে অমঙ্গল থেকে রক্ষা করুন, আপনি যাকে সেদিন অমঙ্গল থেকে রক্ষা করবেন, তার প্রতি অনুগ্রহ করবেন। সেটি হবে মহাসাফল্য। (সূরা মুমিন: ৭-৯)

এসব আয়াহে যে ছবি আঁকা হয়েছে, তা মানব প্রকৃতিতে এমন ভয়ের সৃষ্টি করে যেরূপ অজানা বস্তুর ছবি দেখে সে ভীতু-বিহ্বল হয়ে পড়ে। আবার অজানা-অচেনা জগৎ সম্পর্কে তার মধ্যে ঔৎসুক্যেরওসৃষ্টি করে। সে এমন এক জগৎ যেখানে ফেরেশতাগণ আরশ বহন করছে এবং সেই সাথে তাঁর গুণগান করছে। সাথে সাথে পৃথিবীতেও এমন কোন বস্তু নেই যা আল্লাহর তাসবহি ও গুণগান করছে না।

অনেক সময় অদৃশ্য বস্তু খাব কাছাকাছিই থাকে কিন্তু মানুসের বুদ্ধির সীমাবদ্তার কারণে তা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হয় না। তবু তা মানুষের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে এবং তা থেকে আল্লাহর কুদরত প্রমাণিত হয়। মানুষের মন তার প্রভাবে ঈমানের আলোতে ঝলমলিয়ে উঠে।

(আরবী***********)

আল্লাহর নিকট আসমান ও জমিনর কোন বিষয়ই গোপন নেই। তিনিই সেই (আল্লাহ) যিনি মায়ের গর্ভে ইচ্ছেমতো তোমদের আকার-আকৃতি বানিয়েছেন। (সূরা আলে ইমরান: ৫-৬)

এ আয়অতে ঐ কথার প্রমাণ, আল্লাহ সমস্তঅদৃশ্য জগতের খবরজানেন। এটি মূলত বিবেকের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রমাণ, এটি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের বিষয় নয়। নিচের আয়াতে এর চেয়েও প্রশস্ত এবং নজর কাড়া এক ছবি আঁকা হয়েছে।

(আরবী***********)

তাঁর কাছেই রয়েছে অদৃশ্য জগতের চাবি। তিনি ছাড়া আর কেউ তাজানে না। জলে ও স্থলে যা আছে তিনি জানেন। তাঁর অজান্তে একটি পাতাও ঝরে না। একটি শস্য দানাও তাঁর অজান্তে অন্ধকার মাটিতে পতিত হয় নাকিংবা কোন আর্দ্র ও শুষ্ক বস্তুওকোথাও পতিত হয় না। সবকিছুই প্রকাশ্য এক কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। (সূরা আন’আম: ৫৯)

আলোচ্য আয়াতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম অথচ শক্তিশালীভাবে আল্লাহর ক্ষমতার বর্ণা দেয়া হয়েছে। দেখানো হয়েছে, আল্লাহর জানার পরিধি কতো বিস্তৃত। এ উদ্দেশ্য বুঝাতে সর্বোত্তম শব্দ চয়ন করা হয়েছে এবং সেই শব্দ দিয়ে চমৎকার ছবি আঁকা হয়েছে। এ আয়াতের শব্দগুলো আল্লাহর ইলমের প্রশস্তাতার প্রকাশ করছে। শুধু তাই নয় বরং এ শব্দগুলো দিয়ে আশ্চর্যজনক এক কাল্পনিক ছবিও আঁকা হয়েছে। যেমন বলা হ য়েছে- ‘কোন পাতাওএমনভাবে ঝরে না যা তিনি জানেন না। আর পৃথিবীর অন্ধকার কোন কোণে এমন একটি দানাও নেই যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন। তাছাড়া তিনি ভেজা কিংবা শুকনো সবকিছু সম্পর্কেই ওয়াকিফহাল।’ মনে হয় এ কোন বর্ণনা নয় বরং হুবহু এক ছবি।

এ আয়াত পাঠ করে মানুষ কল্পনার চোখে গোটা পৃথিবী পরিভ্রমণ করে দেখতে চায়, সেই ঝরা পাতাটি কোথায়? ঐ দানাটাও খুঁজে ফেরে যা অন্ধকারমাটিতে লুক্কায়িত। কিন্তু এগুলোতে আল্লাহ ছাড়া আর কারো জানার উপায় নেই। চিন্তা করতে করতে যখন মানুষ নিজের দিকে ফিরে আসে তখন আল্লাহর ভয় ও মর্যাদা তার ওপর ছেয়ে যায়। ঐ মুহূর্তে সে দরবারে বারী তা’আলার দিকে মনোনিবেশ করে এবং অত্যন্ত তন্ময়তার সাথে তাঁর জ্ঞানের স্বীকৃতি প্রদান করতে থাকে।

এই হচ্ছে আল-কুরআনের যুক্তি-প্রমাণ, যাকে যুক্তিরচিত্রও বলা যেতে পারে। এর সাথে মস্তিষ্ক প্রসূত কি সম্পর্ক থাকতে পারে, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের যুক্তিবাদীগণ দিয়ে এসেছেন?

অনেক জায়গায় মস্তিষ্ক প্রসূত যুক্তি-তর্ককে আল-আন এড়িযে চলেছে। আমরা তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ইরশাদ হচ্ছে:

(আরবী***********)

তোমরা এবং আল্লাহ পরিবর্তে যাদের পূজা করো, সেগুলো জাহান্নামের ইন্ধন হবে। আর তোমরা সবাই সেখানে প্রবেশ কর। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৯৮)

এ আয়াত শুনে আরবের মুশরিকদের ধারণা হয়েছিল, খ্রীস্টানদের মধ্যে এ ধরনের লোক আছে যারা ঈসা (আ) কে ইলাহ মনে করে। তবে কি ঈসা (আ)ও জাহান্নামে যাবে? তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম ও খ্রীস্টানদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটান। এজন্য মস্তিষ্ক প্রসূত যুক্তির অবতারণা করেছে।

এ প্রসঙ্গে নিচের আয়াতটিতে সুন্দর জবাব দেয়া হয়েছে।

(আরবী***********) তারা তোমার সামনে যে উদাহরণ উপস্থাপন করে তা কেবল বিতর্কের জন্যই করে। বস্তুত এরা হচ্ছে বিতর্ককারী সম্প্রদায়। (সূরা যুখরুফ: ৫৮)

অতি সাধারণভাবে বর্ণিত এ বাক্যটি এখানে মানতেক বা যুক্তিশাস্ত্রের কোনসাহায্য নেয়া হয়নি।

যদি কুরআন মস্তিষ্ক যুক্তি-তর্কের স্টাইলে কথা বলতো, তবে কোন কাজই হতো না। কারণ এভাবে কুরআনের মূল লক্ষ্য অর্জিত হতো না। কেননা বাদানুবাদ কিংবা বিতর্কের মাধ্যমে কোন বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। বিশ্বাসের স্থান বিতর্কের ঊর্ধ্বে।

এতে কোন সন্দহ নেই যে, আল-কুরআন মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়ার চেষ্টা করেছে। সে জন্য কাহিনী বর্ণনা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। তদ্রূপ তার মূল বক্তব্যকে উপমেয় স্টাইলে উপস্থাপন করে লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে। যেহেতু আল-কুরআন দ্বীনি ও শৈল্পিক উভয বিষয়ের ধারক ও আঁদার। সে জন্যই আল-কুরআন বক্তব্য উপস্থাপনের যে স্টাইলগ্রহণ করেছে তা সৌন্দর্য ও সুষমার শীর্ষে অবস্থিত।

আল-কুরআনের বর্ণনা রীতি

পেছনের যাবতীয় আলোচনার মূল কথা হচ্ছে আল-কুরআন একক ও ব্যতিক্রমী স্টাইলে তার বক্তব্য পেশ করে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করে। এমনকি দলিল-প্রমাণ কিংবা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের বেলায়ও সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। তাছাড়া কল্পনা ও রূপায়ণের মাধ্যমে প্রতিটি ঘটনাকে ছবির মতো করে উপস্থিত করেছে। অর্থাৎ কুরআন অশরীরি অর্থকে শরীরি এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে উপস্থাপন করেছে।

আমরা দেখতে চাচ্ছি, বর্ণনার এ শৈল্পিক পদ্ধতি কতোটুকু সফল ও কার্যকরী। এটিই আমাদের এ পুস্তকের বিষয়বস্তু। আল-কুরআন আলোচনা করেছে, সেগুলো আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। ইতোপূর্বে আমরা যেসব আলোচনা করেছি সেখানে এসব বিষয়ে কিছু আলোচনা এসেছে, তা শুধু যেসব আলোচনা করেছি সেখানে এসব বিষয়ে কিছু আলোচনা এসেছে, তা শুধু এজন্য, কুরআন সেই বিষয়টিকে কিভাবে উপস্থিত করেছে এবং তার ধরন ও পদ্ধতি কি, সেই সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

অনেকে আল-কুরআনের বিষয়বস্তুকে যখন গভীরভাবে দেখেন, তার প্রশস্ততা, সর্ব ব্যাপকতা ও মাহাত্ম্য সম্পর্কেক চিন্তা-ভাবনা করেন তখন বলে উঠেন- এ বিষয়বস্তুই এর স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। আর এটিই যথেষ্ট। আল-কুরআনের বর্ণনা, এপ্রোচের ঢং ও তার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ, সেগুলো গৌণ ব্যাপার। তাদের দৃষ্টিতে আল-কুরআনের অলৌকিকত্ব, তা সবটুকুই বিষযবস্তুর মধ্যে। আবার অনেকে শব্দ ও বাক্য নিয়ে আলোচনা করেন এবং বলেন- আল-কুরআনের অলৌকিকত্ব পৃথক পৃথকভাবে উভয়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট।

এ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- আল-কুরআন তার বর্ণনার যে স্টাইল অবলম্বন করেছে, উদ্দিষ্ট বিষয়বস্তু তা থেকেই সৃষ্ট। তাই দুটোর মর্যাদাই সমান। আমরা শব্দ ও অর্থ নিয়ে অনর্থক বিতর্কে জড়ান পসন্দ করছি না। যদিও প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ভাষাতত্ত্ববিদগণ সেসব শব্দ ও অর্থ নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়েছেন।

ইবনু কুতাইবা, কুদামাহ, আবু হিলাল আসকারী প্রমুখ সাহিত্যিক ও ভাষাতত্ত্ববিদগণ এ বিষয়ে কলম ধরেছেন। তবে আমরা মনে করি এ বিষয়ে আবদুল কাহির জুরজানী ‘দালাইলুল ইজায’ নামক গ্রন্থে যা বলেছৈন তা গভীর পাণ্ডিত্য ও ভারসাম্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন- একজন জ্ঞানীব্যক্তি একথা চিন্তাও করতে পারেন না, শব্দ নিয়ে কোন বিতর্ক চলতে পারে, তা শুধু এজন্য। অবশ্য শব্দটি কি অর্থে প্রয়োগ করা হবে তা নিয়ে কথা হতে পারে। মনোপুত কোন অর্থ নিয়েও বিতর্ক হতে পারে না। হ্যাঁ, অর্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট যে বিতর্ক করা যেতে পারে তাহলো- বোধগম্য অর্থটি কোন্‌ শব্দের সাথে সংশ্লিষ্ট। শব্দটি সেই অর্থেরই প্রতনিধিত্ব করে। তাছাড়া সেই অর্থ কেবল তখনই প্রকাশ হতে পারে, যখন তা এক বিশেষ ছন্দে ও মাত্রায় সংকলনকরা যায়, নইলে নয়। শব্দ বিন্যাস ও ছন্দ পৃথক পৃথক হবে অথচ অর্থেরও মিল থাকবে, তা সম্ভব নয়।

যদি আবদুল কাহির জুরজানী এ উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে কিছু লিখতেন, আমরা তা হুবহু তুলে দিতাম। কিন্তু আফসোস, তিনি পুরোপুস্তকই এ আলোচনা দিয়ে ভরে দিয়েছেন। সেজন্য আমরাতার চিন্তাকে পুরোপুরি ‍উপস্থাপন করতে পারছি না।এমনকি কোন অংশের উদ্ধৃতিও দিতে পারছি না। আমরা দেখেছি তার উপকরণ বড় জটিল।

তবে বলিষ্ঠভাবে যেকথাটি বলা যায়, তা হচ্ছে- এসব ব্যাপারে সমাধানের যোগ্যতা তার ছিল। যদি তিনি বিষয়টি নিয়ে আরেকটু অগ্রসর হতেন, তাহলে তিনি শৈল্পিক চূড়া স্পর্শ করত পারতেন।

আমরা আবদুল কাহিরের দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে বলতে চাই, তার রচনার বিন্যাস ও ছন্দ, অর্থের চিত্রাংকনে বড় প্রদর্শনী। যেখানে অন্তর্নিহিত একটি অর্থ বুঝানোর জন্য দুটো পদ্ধতি অবলম্বনকরা হয়, সেখানে মন ও মানসে দুটো ভিন্ন অর্থই প্রতিভাত হয়্ মনে হয় সেই অর্থ ও বর্ণনার ধরনের মধ্যে এমন একটি সম্পর্ক আছে যাগ্রহণের পর সেই ব্যাপারে আর কোন সম্ভাবনা অবশিষ্ট্য থাকে না, যাতে শব্দ ও অর্তের মধ্যে পৃথক চিন্তা করা যেতে পারে। একটি অর্থের প্রকাশ এমনভাবে হয় যখন বিন্যাস ও মিল এক রকম হয়। শব্দের অবস্থা ভেতে যতোটুকু পরিবর্তন প্রতিভাত হবে অর্থের মধ্যেও অনুরূপ পরিবর্তন সাধিত হয়। অনেক সময় মেধাগত দিক প্রভাবিত হয় না কিন্তু মন-মানসিকতার পরিবর্তন হযে যায়। প্রকাশ থাকে যে, শিল্পকলায় যে স্টাইলে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তা শুধু মনোজগতকে প্রভাবিত করার জন্যই করা হয়। এজন্যই যখন বাক্যের প্রভাবে পরিবর্তন সূচিত হবে তখন অর্থের মধ্যেও পরিবর্তন আসবে।

উপরোক্ত আলোচনা একথারই ইঙ্গিত করে, আল-কুরআনে দৃশ্যায়নের যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি সেই বর্ণনা পদ্ধতি যেখানে কুরআনী অর্থ, উদ্দেশ্য ও বিষয়কে সেই রূপই দেয়া হয়েছে, যে রূপে আমরা তা দেখতে পারি। আর এ অবস্থাটি তার মান-মর্যাদার নির্ণায়ক। যদি সেখানে এ অবস্থা না হয়ে অন্য কিছু হতো তাহলে বর্তমানের মতো তা গুরুত্বপূর্ণ হতো না।

উদাহরণ দিয়ে আমরা বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করতেচাই। যদিও এ পুস্তকের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের উদাহরণ আছে এবং আমরা সে বিষয়ে বিশদ বিবরণও দিয়েছি যা থেকে আল-কুরআনের বাচনভঙ্গির ধরনটিসুস্পষ্ট হয়ে গেছে। তবু যেহেতু এটি পুস্তকের শেষ অধ্যায় এজন্য আমরা ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ স্বরূপ আরও কিছু আলোচনার উদাহরণ পেশ করছি। কারণ, আমাদের কাছে তো উদাহরণের অভাব নেই।

আল-কুরআনের বর্ণনার-রীতির প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইন্দ্রিয়াতীত অবস্থাকে চিত্ররূপ দিয়ে তাকে বোধগম্য অবস্থায় তুলে ধরা। একই পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক চিত্র, অতীতের ইতিহাস, ঘটনা ওউদাহরণ, কিয়ামতের দৃশ্যাবলী, শাস্তি ও শান্তির দৃশ্যসহ মানুষের স্বরূপকে এমনভাবে আল-কুরআন তুলে ধরেছে, মনে হয় এরা সবাই চোখের সামনে উপস্থিত। এভাবে কুরআন চৈন্তিক বিষয়কে ইন্দ্রিয়ানুভূতির আওতায এনে দিয়েছে। আবার চিন্তা শক্তির মাধ্যমে সেগুলোর মধ্যে গতিও সৃষ্টি করা হয়েছে। যা কল্পনার চোখে সর্বদা চলমান মনে হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আল-কুরআন দৃশ্যায়নের যে পদ্ধতিগ অবলম্বন করেছে তা অন্য পদ্ধতি থেকে গুরুত্বপূর্ণ কেন, যেখানে অর্থ এবং অবস্থা আসল রূপে বর্ণনা করা হয়? তদ্রূপ কেন দুর্ঘটনা কিংবা কাহিনীকে প্রকৃত অবস্থায় বর্ণনা করা হয়। যদি কোন দৃশ্যের বর্ণনা উদ্দেশ্য হয় এবং তাও যদি সাদামাঠা কিছু শব্দে বর্ণনা করা হয়, তার কল্পিত চিত্র না আঁকাহয়।

আল-কুরআনেরগৃহীত ধরন ও পদ্ধতির মর্যাদা সম্পর্কে শুধু এতোটুকু বলাই যথেষ্ট, প্রথমে আমরা সেগুলো তার আসল সুরুত বা অবগুণ্ঠন মুক্ত অবস্থায়ই দেখি। তারপর দৃশ্যাকারে কল্পনায় তা সামনে নিয়ে আসাহয়। এভাবে উভয় অবস্থা পরস্পর সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

প্রথম অবস্থায় অর্থ, মেধা ও অনুভূতিকে সম্বোধন করে এবং বহনকারী প্রতিবিম্ব থেকে পৃথক হয়ে তার কাছে পৌঁছে। আর যখন চিত্রায়ণ পদ্ধতিতে অর্থ ইন্দ্রিয় ও বিবেককে সম্বোধন করে এবং ভিন্ন পথে মানুষের কাছে পৌঁছে। এভাবেই বিবেক প্রভাবিত হয়ে পড়। ব্যতিক্রমী পথে এ প্রভাব মানুষের কাছে পৌঁছে। সেসব পথের মধ্যে মেধাও একটি পথ। এটি বলা যাবে না যে, মেধা-ই একমাত্র পথ। এ পথ ও পদ্ধতি ছাড়া আর কোন পথই নেই।

এতে কোন সন্দেহ নেই, আল-কুরআনদৃশ্যায়নের যে স্টাইল গ্রহণ করেছে তা অত্যন্ত চমকপ্রদ।

সকল আকীদার দাওয়াত দিতেই এ পদ্ধতিটি ভারসাম্যপূর্ণ কিন্তু আমরা শুধু শৈল্পিক সৌন্দর্যের দিকটিই যাচাইকরতেচাই। নিঃসন্দেহে এ বর্ণনারীতি শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এজন্য শৈল্পিক প্রথম দাবি, বিবেককে প্রভাবিত করে সেখানে শৈল্পিক আকর্ষণ সৃষ্টি করা । সেই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে জীবনের অভ্যন্তরীণকে আলোকজ্জ্বল করা এবং দৃশ্যের মাধ্যমে চিন্তাশক্তির খোরাক যোগান। উদ্দিস্ট বাক্যটি এভাবেই সচিত্র ও মূর্তমান হয়ে উঠে। ইতোপূর্বে আমরা যেসব উপমা দিয়েছি তা থেকে একটি উপমা পুনরায় তুলে ধরলাম।

১. ঈমানের প্রতি কঠোর ঘৃণা প্রকাশের কথাটি, যারা ঈমানের পথ থেকে দূরে চলে যায়, তাদেরকে কুরআন সোজাসুজি বলে দিলেই পারতো, অমুক অমুক ব্যক্তি ঈমানকে ঘৃণা করে। এ বাক্যটি শুনামাত্র মানুষের চিন্তায় ঘৃণার কথাটির বদ্ধমূল হয়ে যেতো এবং পূর্ণনিশ্চয়তা ও এতমিনানের সাথে এ শব্দটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারতো। কিন্তু এ ঘৃণার বহিঃপ্রকাশের চিত্রটি নিচের বাক্যটির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে এভাবে:

(আরবী***********)

তাদের কি হলো, তারা উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? যেন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গর্দভ, হট্টগোলের কারণে পলায়নপর। (সূরা আল-মুদ্দাসির: ৪৯-৫১)

এ পদ্ধতিতে বর্ণনায় মেধার সাথে সাথে দৃষ্টিশক্তি এবং চিন্তাশক্তিও অংশগ্রহণ করে। সেই সাথে যারা ঈমানকে ঘৃণা করে তাদের একটি সুন্দর ব্যাঙ্গচিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। জঙ্গলী গাধা যেমন শোরগোল শুনে পালাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে দিক-বিদিক দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে, তেমনিভাবে কাফির ও মুশরিকরাও আল্লাহর কথা শুনে পালাতে চেষ্টা করে। এ ছবিতে শৈল্পিক সৌন্দর্য তখনই সৃষ্টি হয় যখন কল্পনায় হট্টগোলের কারণে গাধার দলের দৌড়ে পালান, নড়াচড়া এবং তাদের পিছু ধাবমান বাঘের দৃশ্যটি চোখের সামনে ভেসে উঠে।

২. আরবরা যেসব বাতিল মা’বুদের উপাসনা করতো তাদের দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের কথাটি সাদামাটাভাবে বলে দিলেই হতো, ‘আল্লাহকে ছাড়া তোমরা যাদেরকে ডাক তারা আল্লাহর এক নগণ্য ‍সৃষ্টির চেয়েও দুর্বল।’ এভাবে বক্তব্যটি অন্য কিছুর সাথে না মিলে সোজা মানুষের চিন্তার দরজায় পৌঁছে যেতো।

কিন্তু তা নাকরেবরং চিত্ররূপ দেয়া হয়েছে। এভাবে:

(আরবী***********)

তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা-অর্চনা করো, তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একতি হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তারা মাছির কাছ থেকে তা উদ্ধার করতেও সক্ষমনয়। প্রার্থনাকারী ও যার প্রার্থনা করা হয় উভয়েই কতো অসহায়। (সূরা আল-হাজ্জ: ৭৩)

মূর্ত ও চলমান হয়ে গোটা চিত্রটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে এবং তা তিনটি স্তরে প্রতিভাত হয়।

(১) তাদের বাতিল মা’বুদরা একটি মাছিও সৃষ্টি করতেসক্ষম নয়।

(২) সবাই মিলে যদি চেষ্টা করেতবু নয়।

(৩) সৃষ্টিতো দূরের কথা,মাছি যদি তাদের কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তারা সেই বস্তু মাছির কাছ থেকে উদ্ধার করতেও সম্পূর্ণ অক্ষম।

এ হচ্ছে তাদের (বাতিল মা’বুদের) দুর্বলতা ও অক্ষমতার ছবি। এ ছবিতে এমন ভঙ্গিতে বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে মানুষের মনে বাতিলমা’বুদদের সম্পর্কে অবজ্ঞা ও ঘৃণারসৃস্টি হয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে কি মিশ্রতার অতিশয়োক্তি ঘটানো হয়েছে? এবং বালাগাত (ভাষার অলংকার) কি মিশ্রতারঅতিশায়োক্তিতে একাকার হয়ে গেছে? নিশ্চয়ই নয়। এখানে অতিশয়োক্তির কোন উপাদান নেই। ‍মূল কথাহচ্ছে, সমস্ত বাতিল মা’বুদরা যদি একটি মাছি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে ত বু তা করতে সক্ষম হবে না। নিঃসন্দেহেমাছি অত্যন্ত ছোট্ট ও নগণ্য একটি প্রাণী। কিন্তু তা সৃষ্টি করার পেছনে থাকে। এ ‘মুজিযা’ জীবনসৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত। চাই তা কোন বড় প্রাণীর সৃষ্টি হোক কিংবা কোন ছোট প্রাণীর। শুধু বড় বড় প্রাণী সৃষ্টি করাটাই মুজিযা নয় বরং অতি তুচ্ছ ও নগণ্য একটি প্রাণী সৃষ্টির ব্যাপারেও অলৌকিকতা বিদ্যমান।

এই ছবিতে যে শৈল্পিক সৌন্দর্য বর্তমান, তা হচ্ছে- তারা যেহেতু (বাতিল মা’বুদরা) একটি ছোট্ট মাছি সৃষ্টিকরার যোগ্যতাও রাখে না,কাজেই তারা আর কি সৃষ্টি করতেসক্ষম। এ থেকে আপনা আপনি তাদের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তারপর বলা হয়েছে সৃষ্টি তো দূরের কথা যদি এ ছোট্ট মাছিটি তাদের কোন কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তা উদ্ধার করতেও তারা সক্ষম নয়। এসব কিছুই শৈল্পিক সৌন্দর্যেরউপকরণ।

৩. কিয়ামতের ভয়াবহতারকথা বর্ণনা করতে গিয়ে সাধারণভাবে বলে দিলেই হতো “সেদিন বন্ধু বন্ধুকে ভুলে যাবে, আর যাদের অনুসরণ ক রা হয় তারা তাদের অনুসারীদের প্রত্যাখ্যান করবে।” এভাবে বলে দিলে যে বর্ণনা একেবারে মানসম্পন্ন হতো না, তা ঠিকক নয়। কিন্তু এজন্য কুরআন যে ঢংয়ে ছবি এঁকেছে এর সাথে তারকোন সম্পর্ক নেই, বরং এটি প্রাণ স্পন্দনে ভরপুর।

(আরবী***********)

(সেদিন অনুসারীরা নেতাদেরকে বলবে: ) আমরাতো তোমাদের অনুসারী ছিলাম- অতএব তোমরাআল্লাহর আযাব থেকে আমাদের রক্ষা করবে কি? তারা বলবে: যদি আল্লাহ আমাদেরকে সৎপথ দেখাতেন তবে আমরা তোমাদেরকে অবশ্যই সৎপথ দেখাতাম। এখন আমরা ধৈর্যচ্যুত হই বা ধৈর্য ধারণ করি সবই সমান, আমাদের রেহাই নেই। যখন সব কাজের ফয়সালা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে: নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা করছিলেন এবং আমি তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলাম, আজ ভঙ্গ করছি। তোমাদের ওপরতো আমার কোন ক্ষমাতা ছিল না, শুধু এটুকু ছাড়া, আমি তোমাদেরকে আহ্বান করেছি আর তোমরা সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছ। অতএব তোমরা আমাকে ভর্ৎসনা করো না বরং নিজেদেরকে ভর্ৎসনা করো। আমি তোমাদেরে কোন উপকার করতে সক্ষম নই, আর তোমরাও আমার কোন উপকার করতে পারবে না। ইতোপূর্বে তোমরা আমাকে আল্লাহর সাথে শরীক করেছ, আমি তা প্রত্যাখ্যান করলাম। বস্তুত যারা জালিম তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাকদায়ক শাস্তি। (সূরা ইবরাহীম: ২১-২২)

উপরিউক্ত আয়াতে তিনটি দলের চিত্র অংকিত হয়েছে। যা মূর্তমান হয়ে কল্পিত দৃশ্যে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়।

ক. দুর্বল লোক

এরা বড় লোকদের করুণা ভিখারী ছিল। এরা সর্বদা নিজেদের দুর্বলতা, ‍মুর্খতা ও মুখাপেক্ষীতারকারণে নেতাদের জামার আস্তিনের মধ্যে আশ্রয় খুঁজতে ব্যাকুল থাকতো। কিয়ামতের দিন তারা তাদের নেতাদের নিকট প্রথমে এ অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য নিবেদন করবে। তারপর তারা তাদেকে গুমরাহ করার জন্য দায়ী করবে।

খ. অহংকারী

এ দলটি হচ্ছে- নেতৃস্থানীয়, আমীর-ওমরা গোছের লোক, তখন লাঞ্ছনা ও অপমানে অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। নিজেদের পরিণতি তারা দেখতে পাবে। তাদের অনুসারীদেরকে দেখে তারা অত্যন্ত রাগান্বিত হবে। এদিকে অনুসারীদের অবস্থাহবে, নেতাদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত অবস্থা দেখেও তারা বিরত না হয়েতাদের নিকট মুক্তির জন্য আবেদন জানাবে। অথচ তারাই তখন মুক্তির জন্য অপরের মুখাপেক্ষী থাকবে। কিন্তু কেউ তাদের জন্য এগিয়ে আসবে না। তখন অনুসারীরা বলতে থাকবে-এ নেতারা তো আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছে। অবশ্য এতে কোন উপকার তাদের সেদিন হবে না। আর নেতারা শুধু একথা বলেই চুপ হয়ে যাবে, যদি আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েতের পথ দেখাতেন তবে আমরাও তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করতে পারতাম।

গ. শয়তান

ইবলিস ধোঁকা, প্রতারণা এবং শয়তানীসহ সমস্ত অপকর্মের হোতা। সেদিন সে তার অনুসারীদেরকে লক্ষ্য করে বলবে: ‘আল্লাহ তোমাদেরকে সত্য ওয়াদা করেছিলেন কিন্তু আমি যে ওয়াদা তোমাদের কাছে করেছিলাম তা ছিল মিথ্যে, প্রতারণা। তারপর স্পষ্ট ভাষায় বলে দেবে: আমি তোমাদেরকে জোর করে পথভ্রষ্ট বানাইনি। আমিতো শুধু তোমাদেরকে আহ্বান করেছি, অমনি তোমরা দৌড়ে এসেছ। কাজেই আজ আমাকে ভর্ৎসনা না করে নিজেদেরে ভর্ৎসনা করো।

এরপর সে শেষ কথা বলে দেবে। তোমরা যে সমস্ত কাজে আমাকে অংশীদার মনে করেছো, সে সমস্ত কাজের দায়-দায়িত্ব থেকে ইম নিজেকে মুক্ত ঘোষনা করছি।

ওপরের ছবিতে যে দৃশ্যের উপস্থাপন করা হয়েছে তা একক ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ দৃশ্যে আমরা দেখি নেতা ও অনুসারীগণ কেউ কাউকে চিনছে না। সবাই নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছে। তবু সে স্বীকারোক্তি কোন কল্যাণ বয়ে আনছে না। উপরন্তু এ বীভৎস্য দৃশ্য দেখে নিজের অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, যদি সে এমন কথা না-ই বলবে তবে আর তাকে শয়তান বলা হবে কেন। এ চিত্রটি মানুষের পুরো মনকে আচ্ছন্ন করে রাখা। যদি সাসিদেভাবে কথাগুলো বলে দেয়া হতো, তবে ঐ শৈল্পিক সৌন্দর্য আর প্রস্ফুটিত হতো না, যা এই চিত্রে হয়েছে।

৪. সাধারণভাবে শুধু একথা বলে দিলেই হতো, কাফির-মুশরিকরা যে আল করেছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই এ অগ্রহণযোগ্য আমলকে যসব কাফিররা প্রাধান্য দিচ্ছে তারা নিঃসন্দেহেবোকার স্বর্গে বাস করছে। তারা স্থায়ী বিভ্রান্তির শিকার সেখান থেকে তাদেরকে ফেরান বা সঠিক পথ প্রদর্শনের আর কেউ নেই। তাদের মস্তিষ্ট এ বুঝকে গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু যখন এ কথাগুলো এভাবে বলা হয় যেভাবে নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে তখন তারমধ্যে জীবনের স্পন্দন এবং গতি সৃষ্টি হয়ে যায়। ইচ্ছে-অনুভূতির পৃথিবীকে আলোড়িতহকরে।

(আরবী*************)

যারা কাফির তাদেরকর্ম মরুভূমির মরীচিকার মতো, যাকে তৃষ্ণার্ত ব্যক্তিপানি মনে করে। এমনকি, সে যখন সেখানে যায়তখন কিছুই পায় না, পায় আল্লাহকে। অতপর আল্লাহ তার হিসেব চুকিয়ে দেন। আল্লাহতো দ্রুত হিসাবগ্রহণকারী। অথবা (তাদের কর্ম) উত্তাল সমুদ্রবক্ষে গভীর অন্ধকারের ন্যায়, যাকে উদ্বেলিতকরে তরঙ্গের পর তরঙ্গ এবং ওপর ঘনকালো মেঘ। অন্ধকারের ওপর অন্ধকার। এমনকি যখন সে তার হাত বের করে তখন তা একেবারেই দেখতে পায় না। বস্তুত আল্লাহ যাকে আলোহীন করেন সে কোন আলোই পায় না। (সূরা নূর: ৩৯-৪০)

আলোচ্য আয়াতে এমন শৈল্পিক এক ছবি আঁকা হয়েছে যা একজন মানুষকেচূড়ান্ত ভাবে সম্মোহিত করে দেয়। এ যেন এক রূপকথা। চিন্তাশক্তি এখানে তার সমস্ত ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়েছে, কিন্তু রঙিন ছবির উপকরণ এবং তাকে চলমান করার জন্য এখনও এক বিরল তুলি এবং উৎকৃষ্ট ক্যামেরার প্রয়োজন।

প্রশ্ন হচ্ছে এমন তুলি ও ক্যামেরা কোথা থেকে সরবরাহ করা হবে যা সেই অন্ধকারকে উজ্জ্বল তরকরে ফুটিয়ে তুলবে এ আয়াতে যে অন্ধকারের কথা বলা হয়েছ। তারপর এর পিপাসার্তের ছবি যে মরীচিকার পেছনে দৌড়ে চলছে, সেখানে পৌঁছে কিছুই দেখতে পাবে না। হ্যাঁ, হঠাৎ সেখানে এমন জিনিস পায় যা সে স্বপ্নেও চিন্তা করেনি। অর্থাৎ মহান আল্লাহর সত্তা। অতপর আল্লাহ চোখের পলকে তার হিসাব চুকিয়ে দেন।

এ আয়াতে আমরা সেই দ্বীনি উদ্দেশ্য দেখতে পাই- যে জন্য এ ‍দৃশ্যটির অবতারণা করা হয়েছে। সেই সাথে আমরা অত্যাধুনিক এক শিল্পকলারও পরিচয় পাই, যা সদা প্রাণবন্ত এ ছবিতে বিদ্যমান।

৫. নিজের আয়াত ক’টিতে হেদায়েত পাওয়ার পর যারা গুমরাহ হয়ে যায় তাদের সুন্দর একটি চি ত্র তুলে ধরাহয়েছে। পূর্বের দেয়া উদাহরণের সাথে এটিরমিল আছে। এখানেও কিছুজীবন্ত ছবি একের পর এক পাওয়া যায়। ইরশাদ হচ্ছে:

(আরবী*************)

তারা সেই সমস্ত লোক যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গুমরাহী খরিদ করে। বস্তুত তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি এবং হেদায়েতও তাদের নসীব হয়নি। তাদের অবস্থা সেই ব্যক্তির মতো, যে কোথাও আগুন জ্বালাল, যখন আগুন তার চতুর্দিকে আলোকিতকরে ফেললোতখন আল্লাহ তার চারিদিকের আলো উঠিয়ে নিলেন এবংতাদেরকে অন্ধকারে ছেড়ে দিলেন। ফলে তারা কিছুই দেখতে পায় না। তারা বধির, মূক ও অন্ধ। সুতরাং তারা ফিরে আসবে না। আর তাদের উদাহরণ সেই সব লোকের মতো, যারা দুর্যোগপূর্ণ ঝরের রাতে পথ চলে, যা আধাঁর, গর্জন ও বিদ্যুৎ পেতে চায়, অথচ সমস্ত কাফিরই আল্লাহ কর্তৃক পরিবেষ্টিত। বিদ্যুতের চমকে যখন সামান্য আলোচিত হয় তখন কিছুটা পথ চলে। আবার যখন অন্ধকার হয়ে যায়, তখন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। আল্লাহতো সবকিছুর ওপরই পূর্ণ ক্ষমতাবান। (সূরা আল-বাকারা: ১৬-২০)

উল্লেখিত আয়াত ক’টিতে পর্যায়ক্রমে এক মনোজ্ঞ চিত্র অংকন করা হয়েছে। কিছুলোক রাতের আঁধারে আগুন জ্বালাল, তাতে তাদের চারদিকে আলোকিত হয়ে গেল, হঠাৎ সে আলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় তারা সীমাহীন আঁধারে ডুবে গেল এবং সেই আঁধারের মধ্যেই তারা পথ চলতে লাগল। সাথে শুরু হলো ঝড়-বৃষ্টি।

একদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত, অপরদিকে মেঘের শুরু-গম্ভীর নিনাদ, সাথে বিদ্যুতের চমক। ভয়ে দিশেহারা। বিজলীর সামান্য ঝিলিক দেখলেই বজ্রপাতের ভয়ে কানে আঙ্গুল ঠেসে ধরে। আবার বিজলীর ঝিলিক সামান্য ক্ষণের জন্য আলোকিত হয়, সে আলোকে ক’কদম পথচলে পুনরায় থমকে দাঁড়ায়। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তখন কি করবে।

এরূপ জীবন্ত ও চলমান ‍ছবি তুলতে অত্যন্ত মূল্যবান ও স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরার প্রয়োজন। কিন্তু এখানে ক্যামেরা নয়সামান্য ক’টি শব্দের মাধ্যমে জীবন্ত ও চলমান ছবিটি উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানে ছবিটিকে প্রাণবন্ত ও চলমান করার জন্য এমন কিছু আছে কি, যা ক্যামেরার দ্বারা সম্ভব- কিন্তু শব্দে দ্বার সম্ভব হয়নি? বরং মানব সত্তা শাব্দিক ছবি দেখেই বেশি আনন্দিতহয়। কারণ এর সাথে চিন্তাশক্তিও কাজ করে। সে ছবি আঁকে আবার মুছে দেয় এবং ছবিকে চলমানওকরে। এ সময় মানব সত্তার মধ্যে আবেগের ঢেউ খেলে যায়। বিবেক প্রভাবিত হয়। হৃদ্পন্দন বেড়ে যায়। জানেন এটি কেন হয়? শুধু কিছু শব্দের প্রভাবে।

উপসংহার

কুরআনে কারীমে চিত্রায়ণের যে পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে তার উপসংহারে আমর ঐ জীবনী শক্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই যা দৃশ্যসমূহের মধ্যে সৃষ্টিহয়ে থাকে এবং যার উদাহরণ এ পুস্তকের বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু দৃশ্যকে জীবনের স্পন্দন দিয়ে চলমান এ পদ্ধতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

কুরআনে কারীমে উপস্থাপিত ছবি শুধু এরূপ নয় যে,তার প্রকৃত অর্থটিই ছবিতে রূপান্তর হয়ে যায় বরং সেই ছবিতে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করা হয়। এবং তাকে জীবন্ত বস্তুর সাথে তুলন করে যাচাই- বাছাইও করা যায়।

উদাহরণ স্বরূপ কিয়ামতের বিভীষিকাময় চিত্রটির কথা বলা যেতে পারে। সেখানে দেখানো হয়েছে দুগ্ধদানরতম মা তার সন্তানের কথা ভুলে গিয়ে ছুটতে থাকবে। গর্ভবতী মহিলার গর্ভপাত হয়ে যাবে। মানুষ দিশেহারা হয়ে মাতালের মতো টলতে টলতে দৌড়াতে থাকবে, প্রকৃতপক্ষে তারা নেশাগ্রস্ত হবে না। এ অবস্থা শব্দের দ্বারা নয় ভীতির দ্বারা সৃষ্ট যা মানুষকে প্রভাবিত করে। এ অবস্থার সৃষ্টি শব্দ থেকে নয়, ভয়ঙ্কর ঐ অবস্থা থেকে যা মানুষের ওপর সংঘটিত হয়।

অন্যত্র সেই বিভিষিকার চিত্র অংকিতহয়েছে এভাবে: মানুষ সেদিন পিতা, মাতা, ভাই ও বন্ধুদের থেকে পালিয়ে বেড়াবে।

(আরবী*************) সেদিন প্রত্যেকেরই একই চ্তিা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। (সূরা আবাসা:৩৭)

কিয়ামতের সেই ভয়াবহ চিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করাহয়েছে,যা দেখে মানুষ পেরেশান হয়ে যায়। ঘটনা যাচাই-বাছাই করার জন্য কোন কিছুর প্রয়োজন হয় না। ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় সেই চিত্রে স্থির ও প্রাণহীন বস্তুকেও জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। যেন তারাও তাদের সাথে শামিল হয়ে যায়। ইরশাদ হচ্ছে:

(আরবী*************)

সেদিন পৃথিবী পর্বতমালা কাঁপতে থাকবে এবং পর্বতমালা গুঁড়ো হয়ে বালুর ঢিবিতে রূপান্তর হবে। (সূরা আল-মুজ্জাম্মিল: ২৪)

মনে হয় পৃথিবী কোন জীবন্ত বস্তু, যা ভয়ে কাঁপতে থাকবে।

(আরবী*************)

অতএব তোমরা কিভাবে আত্মরক্ষা করবে, যদি তোমরা সেদিনকে অস্বীকার করো যেদিন বালককে বৃদ্ধ করে দেবে সেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে। (সূরা আল-মুজ্জাম্মিল: ১৭-১৮)

এ আয়াতে প্রথমে বালককে বৃদ্ধ বানিয়ে দেবার কথা বলা হয়েছে,তারপর আসমান ফেটে যাবার কথা বলা হয়েছে।

হযরত নূহ (আ) এর ঘটনায় তুফানের বিভীষিকাময় চিত্রটি একদিকে যেমন প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাধ্যমেতুলে ধরা হয়েছে, অপরদিকে পিতা ও পুত্রের মাধ্যমে এক করুণ চিত্র অংকিতহয়েছে। পিতা নৌকায় আরোহণ করে প্লাবন থেকে বেঁচে যাচ্ছেন কিন্তু কলিজার টুকরা পুত্রের জন্য তিনি পেরেশান। প্লাবন পুত্রকে গ্রাস করে নিচ্ছে। (পিতা চিৎকার করে বলছেন:) ‘আজতো সেই রক্ষা পাবে যাক আল্লাহ অনুগ্রহ করবেন।’ ঝড়-তুফান ও প্লাবনের এক বিভীষিকাময় চিত্রঅংকন করতে গিয়ে বলা হয়েছে: বড় বড় পাহাড় সমান ঢেউয়ের মধ্যে কোন নৌকা চলতে লাগল। পিতা ও পুত্রের বিচ্ছেদের মাধ্যমে এদৃশ্যকে আরও করুণ অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ করুণ অবস্থাটি এমন, যাকে ঝড়-তুফানের বিভীষিকাও ঢেকে দিতে পারেনি।

জাহান্নামদের দুঃখ-কষ্টের প্রকাশ ঘটবে চিৎকারের মাধ্যমে, যার ছবি নিচের শব্দমালায় আঁকা হয়েছে:

(আরবী*************)

তারা চিৎকার করে বলবে: হে মালিক! তোমার রব্বকে বলো আমাদেরকে যেন মৃত্যু দিয়ে দেন। সে বলবে: তোমরা এভাবেই থাকবে। (সূরা আয-যুখরুফ: ৭৭)

(আরবী*************) এবং তারা (জাহান্নামীরা) সেখানে চিৎকার করতে থাকবে।

কিয়ামতের দিন একজন জাহান্নামী লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে কি অবস্থায় পৌঁছবে তা শুধু কয়েকটি শব্দেরমাধ্যমেই তুলে ধরা হয়নি বরং তা যেন এক জীবিতমানুষের মুখ দিয়েই বলানো হচ্ছে:

(আরবী*************)

আর যদি দেখ, যখন তাদেরকে প্রতিপালকের সামনে দাঁড় করানো হবে। তিনি বলবেন: ‘এটি কি বাস্তব সত্য নয়?’ তারা উত্তর দেবে: ‘হ্যাঁ, আমাদের প্রতিপালকের শপথ।’ তখন তিনি বলবে: নিজেদের কুফুরীর কারণে আজ শাস্তির স্বাদ অস্বাদন করো। (সূরা আল-আন’আম: ৩০)

জাহান্নামরিা কিয়ামতের দিন প্রকাম্যে আফসোস-অনুতাপ করবে, যেভাবে মানুষ কোন সুযোগ হারিয়ে আফসোসকরতে থাকে।

(আরবী*************)

জালিমগণ সেদিন নিজেদের আঙ্গুল কামড়াতে কামড়াতে বলবে: হয় আফসোস! আমি যদি রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম। হায় আমার দুর্ভোগ! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। (আল-ফুরক্বান: ২৭-২৮)

মুমিন এবং কাফিরের অবস্থার চিত্র অংকন করে জিহাদের উৎসাহ দেয়া হয়েছে এভাবে:

(আরবী*************)

তাদের পশ্চাদ্ভাবনে শৈথিল্য প্রদর্শন করো না। যদি তোমরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাক তবে তারাও তো তোমাদের মতোই আঘাতপ্রাপ্ত। আর তোমরা আল্লাহর কাছে আশা করো, তারা আশা করে না। (সূরা আন-নিসা: ১০৪)

কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে ঈমানদার ও কাফিরদের পার্থক্য দেখিয়ে এক ছবি আঁকা হয়েছে। এ পার্থক্য দু’দলের অবস্থান ও তার পরিণতিকে কেন্দ্রকরে।

বিভিন্ন অধ্যায়ে আমরা যেসব দৃশ্যাবলীর বর্ণনা করেছি তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। কুরআনী দৃশ্যসমূহের প্রকার ও তার প্রাণশক্তি সম্পর্কে এ আলোচনাটুকুই যথেষ্ট হবে বলে আমি মনে করি। যেভাবে এক প্রাণের স্পন্দন আরেক প্রাণে সঞ্চালিত হয়। যেভাবে কোন প্রভাব একটি জীবন্ত ও বাস্তব শরীর থেকে আরেকটি জীবন্ত শরীরকে স্পর্খ করে। তেমনিভাবে চিত্র ও বর্ণনার প্রভাবও মানুষের মনে পড়ে এবং সে-ও তার সাথে একাকার হয়ে যায়।

আল-কুরআনের বর্ণনাভঙ্গিরআরো একটি বৈশিষ্ট্য

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর অসামান্য ও অনুপম কলব যেসব জড় বস্তুকে স্পর্খ করেছে তার মধ্যেই জীবনের স্পন্দন সৃষ্টি হয়েছে। যে পুরনো বস্তুকে ছোঁয়া দিয়েছে তা-ই নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এর কারণে সর্বময় ক্ষশতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অলৌকিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সৃষ্টি অন্যান্য মুজিযা বা কুদরতের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়।

সকাল বেলার দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যায়, জীবনের বার বার আসে এ সকাল। কিন্তু কুরআনের বিশেষ বর্ণনায়তা জীবন্ত রূপ লাভ করেছে কিন্তু কোন মানুষের চোখ তা দেখে না।

(আরবী*************) সকাল বেলার শপথ, যখন তা শ্বাস গ্রহণ করে (উদ্ভাসিত হয়)। (সূরা তাকভীর: ১৮)

রাত সময়ের নির্দিষ্ট একটি অংশের নাম কিন্তু কুরআনের বর্ণনায় তাকে জীবিত ও নতুন মনে হয়:

(আরবী*************)এবং রাতের শপথ, যখন তা অতিক্রান্ত হয়। (সূরা আল-ফজর: ৪)

আল-কুরআনের মতে দিন দ্রুতবেগে রাতের পেছনে ধাবমান , রাতকে ধরার জন্যে:

(আরবী*************) তিনি পরিযে দেন রাতের ওপর দিনকে। এমতাবস্থায় দিন দৌড়ে দেওড়ে রাতের পেছনে আসে। (সূরা আল-আ’রাফ:৫৪)

(আরবী*************) এবং সে ছায়া হবে ধুঁয়ার, যা শীতর কিংবা আরামদায়কও নয়। (সূরা ওয়াকিয়াহ:৪৩-৪৪)

দেয়াল পাথরের মতোই এক জড় পদার্থ কিন্তু কুরআন তাকে বোধ ও অনুভূতিসম্পন্ন জীবিতপ্রাণী হিসেবে উপস্থাপন করেছে:

(আরবী*************)

অতপর তারা সেখানে একটি দেয়াল পেলেন, যা ঝুঁকে রয়েছে, পড়ে যাবার উপক্রম, তা তিনি সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। (সূরা কাহাফ: ৭৭)

(আরবী*************)

তারা কি লক্ষ্যকরে না, তাদের মাথার ওপর উড়ন্ত পাখীদের প্রতি পাখা বিস্তারকারী ও পাখা সংকোচনকারী? মহান আল্লাহই তাদেরকে স্থির রাখেন। (সূরা আল-মুলক: ১৯)

আর-কুরআন যেসমস্ত বস্তুর ছবি এঁকেছে তার মধ্যে আসমান, জমিন, চন্দ্র, সূর্য, পাহাড়, জঙ্গল, আবাদী জায়গা, অনাবাদীজমি, গাছপালা ইত্যাদি অন্যতম। এগুলোর জীবন্ত ছবি দিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সে ছবিকে কেউইমৃত বলতে পারবে না, একেবারেজীবন্ত-চলমান।

এ হচ্ছে আল-কুরআনের বর্ণনা ও উপস্থাপনার পদ্ধতি। যা আল-কুরআনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে।

পরিশিষ্ট-১

সাত বছর আগে এ পুস্তকটি প্রথম প্রকাশিত হয়। আলহামদুলিল্লাহ! ভাষাতত্ত্ববিদ, সাহিত্যিক ও দ্বীনি ম হলে এটি সমানভাবে সমাদৃহ হয়েছে। এতে এ সত্য প্রতিভাত হয যে, দ্বঈন এমন বিজ্ঞান ও শিল্পকলা চর্চার পথে অন্তরায় নয় যা যাবতীয় বন্ধন ও শর্তাবলী মুক্ত হয়ে তার উদ্দেশ্য ‍ও বিষয়বস্তুর আলোচনা করেছে।তাছাড়া এ থেকে আরো বুঝা যায়, নিয়ত যদি খালেসহয় এবং আত্মঅহমিকা ও প্রদর্শনেচ্ছা না থাকে তাহলে শিল্প ও বিজ্ঞানের আলোচনা দ্বীনি চেতনার সাথে কোনভাবেই সাংঘর্ষিক নয়। তাই বলে চিন্তা ও দষ্টিভঙ্গির স্বাধীনতার অর্থ মোটেও এই নয় যে, দ্বীন থেকে সম্পূর্ণ ছিন্ন করতে হবে। যা তথাকথিত বুদ্ধিজীবি একদল লোকের ধারণা। কারণ তারা বিশেষ কোন জাতির ও ইতিহাসের ভিত্তিতে এ বিষয়টিকে দেখে থাকে। পাশ্চাত্যে যেমনদ্বীন, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মধ্যে বৈপরীত্য ও সাংঘর্ষিক অবস্থা ‍সৃষ্টি হয়েছে, তেমনিভাবে তারা ইসলামী দুনিয়ায়ও সেইরূপ অবস্থার সৃষ্টি করত চায়। অথচ একটি মুহূর্তের জন্যও ইসলামে দ্বীন, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়নি। ইতিহাস তার সাক্ষী।

দ্বিতীয় আরেকটি কথা, যা এমুহূর্তে বলা অত্যন্ত প্রয়োজন। তা হচ্ছে, চিত্রায়ণ পদ্ধতিই কি আল-কুরআনের প্রধান ও ভিত্তির মর্যাদা রাখে?

এ প্রশ্নের উত্তর আমি ‘আল-কুরআনে কিয়ামতের দৃশ্য’ নামক গ্রন্থের ভূমিকায় এভাবে দিয়েছি:

এ বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণের জন্য কুরআনের আয়াতসমূহগভীরভাবে অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন। এতে কোন সন্দেহ নেই, কুআনী কিস্‌সা-কাহিনী, কিয়ামতের দৃশ্যাবলী, মানবিক উপমা উৎক্ষেপণ এবং প্রজ্ঞাপ্রসূ যুক্তির সাথে যদি মনোজাগতিক অবস্থা, চিন্তা ও মনন, কল্পনা ও রূপায়ণ এবং নবুওয়তের কতিপয় ঘটনার উদাহরণকেও শামিল করা যায়- তাহলে দেকা যাবে সেগুলোর অনুপাত ৪:৩ প্রায়। উপরিউক্ত সবগুলো বিষয়ই চিত্রায়ণ পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। শুধু সেইসবজায়গা ও পদ্ধতির বাইরে রাখা হয়েছে যেখানে শরয়ী কোন নির্দেশ বর্ণিত হয়েছে কিংবা বাইরে রাখা হয়েছে যেখানে শরীয় কোন নির্দেশ বর্ণিতহয়েছে কিংবা যুক্তি-প্রমাণের রীতি অবলম্বন করা হয়েছে। অথচা সাদাসিদাভাবে কোন মাসয়ালা বর্ণনা করা হয়েছে। চিত্রায়ণ পদ্ধতি ছাড়া এরূপ সাদাসিদা বর্ণনা আল-কুরআনে প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। তাই আমার বক্তব্য অতিশয়োক্তি নয় যে, “আল-কুরআনের বর্ণনা পদ্ধতিতে চিত্রায়ণ ও দৃশ্যায়নের ওপর অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।”

যদি আল্লাহ তাওফিক দেন এবং আল-কুরআনের নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ প্রকাশ করি তাহলে লোকের মনে ততোটুকু নিশ্চয়তা আসবে যতোটুকু নিশ্চয়তা আছে আমার মনে। যেমন-

১. তওরাত ও আল-কুরআনের কিস্‌সা-কাহিনী।

২. আল-কুরআনে মানুষের স্বরূপ।

৩. আল-কুরআনে যুক্তি-প্রমাণ।

৪. আল-কুরআনে শেল্পিক উপকরণ।

এটি আমার অত্যন্ত খুশীর ব্যাপার যে, এ পুস্তকের মাধ্যমে আল-কুরআনের চিত্রায়ণ পদ্ধতির দিকে সামান্য হলেও মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে পেরেছি। এটি এ পুস্তকেরই ফল যে, আল-কুরআনের অধিকাংশ পাঠক ও মাদ্রাসার শিক্ষকবৃন্দ এমন জায়গায়ও শৈল্পিক চিত পান, যেসব জায়গার বর্ণনার আমার এ পুস্তকে পওয়া যায় না। এরা যখন কোন জায়গায় শৈল্পিক সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করেন, তখন খুশীতে আত্মহারা হয়ে যান। একইভাবে তারা আল-কুরআন ছাড়াও বিভিন্ন কাব্য ও গদ্যের মধ্যেও শৈল্পিক সৌন্দর্য অনুসন্ধানে লেগে যান।

একজন লেখকের জন্য এটি কোন সাধারণ কথা নয় যে, তিনি শৈল্পিক সৌন্দর্য যে সন্ধান দিলেন তা অন্যান্য লেখকগণও সাদরে গ্রহণ করলেন। এ সৌভাগ্য আমাকে খুশীতে আপ্লুত করেছে। এজন্য আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার লাখো শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।

শিল্পকলা পরিভাষাটির ভুল ব্যবহার

এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয়। আধুনা শিল্পকলা পরিভাষাটির অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে, অথবা তার অর্থ ও তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝা যায় না। কুরআনুল কারীমের তাফসীরেও এ শব্দটির ভুলব্যাখ্যা করা হয়।

স্বীকার করছি, আজ থেকে সাত বছর আগে যখন এ পুস্তকের নামকরণ করলাম ‘আত তাসভীরুল ফান্নী ফিল কুরআন’ (আল-কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য)তখন আমার মাথায় একটি খেয়ালই ছিল- বর্ণনা ও ব্যাখ্যার সৌন্দর্য এবং তার ধরণ প্রকৃতি নিয়ে আলোচনাকরবো। এ রকম চিন্তাও কখনো আসেনি যে, শিল্পকলাকে কুরআনের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দিলে তা মনগড়া জিনিস হয়ে যায়, যার ভিত্তি খেয়ালীপনার ওপর। তার কারণ, আমিকুরআনের যে দীর্ঘ অধ্যয়ন করেছি তাতে এ ধরনের তাৎপর্য গ্রহণ করা যায় না।

আমি স্পষ্ট বলতে চাই এবং স্বীকারও করছি,মস্তিষ্ক প্রসূত কোন জিনিসকে দ্বীনি আকীদা হিসেবে আমি গ্রহণ করিনি। তবে তা এজন্যগ্রহণ করেছি, এছাড়া আর কোন ‍উপায় ছিল না। অবশ্য আমি উপলব্ধি করছি, মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে সমীহ করলেও আমার বিবেক আমাকে বাধ্য করেছে যেন তার সীমালংঘন না করা হয়। শুধু জ্ঞানের ভিত্তিতে এমনকথাকে মেনে নেয়া, যার পেছন কোন দলিল-প্রমাণ নেই।

আমি আশ্চর্য হয়ে যাই, শিল্পকলা পরিভাষাটি এমন মনগড়া ও নতুন অর্থে কেনব্যবহার করা হয় যার সমর্থনে যথার্থকোন প্রমাণ নেই। তাহলে কেন এরূপকরা হয়? এটি কি সম্ভব নয়- সত্যিকারের ঘটনাকে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার ডঙে বর্ণনা করা। যাতেতার সত্যতা ওকাহিনী বলবত থাকে?

তাহলে কি হোমার ইলিয়িডের ভিত্তি মনগড়া কল্প-কাহনীর ওপর রেখেছিল?

পাশ্চাত্যের যেসব গল্পকার, উপন্যাসিক এবং নাট্যকার আছেন তাদের শিল্পকর্মে কি সত্যের লেশ মাত্র নেই?

অবশ্য মিথ্যে একটি গল্পও শিল্পকলার সাথে সম্পর্ক রাখে। কিন্তু শিল্পকলা সেখানে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় না। নিঃসন্দেহে সত্য ও মর্মের ভেতর সেই যোগ্যতা থাকে যা পুরোপুরি শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করা যায়। এটি বুঝতে হলে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। শুধু পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামী পরিহার করতে হবে এবং ভাষার ব্যবহারিক দিকটির প্রতি গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে।

চিন্তা ও দৃষ্টির স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, মানুষ যা ইচ্ছে তাই বলবে এবং যা খুশী তাই করবে। আমরা দ্বীনের পরিত্রার দিকে লক্ষ্য রেখে আল-কুরআনের ওপর ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে নজর দিতে চাই। তাতে আমাদের সামনেযে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে, তা হচ্ছে গোটা সৃষ্টিলোকে এমন কোন গ্রন্থ নেই যা মানব ইতিহাসের এমন ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ বিদ্যমান যেখানে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপকরণ রয়েছে, যতোটুকু উপকরণ আল-কুরআনের ঐতিহাসিক অংশ আছে।

আল-কুরআনের বক্তব্যের যথার্থতা

আল-কুরআনে বর্ণিত ঘটনাবলীর যতার্থতা যাচাইয়ের জন্য আমাদের কাছে শুধু দু’টো উপায় আছে। তার মধ্যে একটিও অকাট্য নয়। তাছাড়া সেখানে প্রমাণের শক্তিও বর্তমান নেই, যা আল-কুরআনে পাওয়া যায়।

উল্লেখিত দু’টো উপায়ের মধ্যে একটি হচ্ছে- ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ। যদি আল-কুরআন দ্বীনি পবিত্রতা থেকে না দেখে শুধু ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেব মূল্যায়ন করা হয়, তো দেখা যাবে বৈজ্ঞানিকদৃষ্টিকোণ থেক পৃথিবীর যাবতীয় ইতিহাস গ্রন্থ হতে এর মর্যাদা ঊর্ধ্বে। এগ্রন্থের বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইবনু আবদুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর পুরনো ও নতুন দুশমনরাও স্বীকৃতি দিতে বাধ্য যে, তিনি অতি সত্যবাদী একজন লোক ছিলেন।

একে শুধু সেই ব্যক্তিই দ্বিমত করতে পারে, যে অপরের প্রতি অপবাদ দেয়ার ব্যাপারে অনড়। কুরআনুল কারীমের সংকলন ও বিন্যাস এমন বিজ্ঞচিতভাবে করা হয়েছে সেখানে খুঁত ধরার কিংবা আঙ্গুলি নির্দেশ করার কোন অবকাশ নেই। একথা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।

আল-কুরআনে যে বৈজ্ঞানক বিশ্লেষণ এসেছে তা অন্য কোন পুস্তকে পাওয়া সহজসাধ্য নয়। চাই তা কোন পবিত্র কিতাব হোক কিংবা ইতিহাসের্ অন্যান্য আসমানী কিতাব যা কালের আবর্তনে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয়েছে। আল-কুরআন যেভাবে পর্যায়ক্রমে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে অন্য কোন কিতাব-ই সেভাবে (সুরক্ষিত অবস্থা) আমাদের কাছে পৌঁছেনি। রইল ইতিহাসগ্রন্থ, যে সম্পর্কে সর্বদা সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ রয়েই যায়। মানব সমাজে যতো ইতিহাস গ্রন্থ আছে তার মধ্যে এমন একটি গ্রন্থও নেই, যার যাবতীয তথ্য-উপাত্য সুনিশ্চিত বলে ধারণা করা যেতে পারে।

এ কারণেই বুদ্ধি ও যুক্তির কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না যে, একটি সাধারণ ইতিহাসের মানদণ্ডেআল-কুরআনের ঐতিহাসিক অংশের মূল্যঅয়ণ করা হবে। বিশেষ করে সেই ইতিহাসর সাথে যা যথার্থ নয়।

দ্বিতীয উপায় হচ্ছে- জ্ঞান বুদ্ধি। আমি নির্ধিায় সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত সমানার্হ ও গ্রহণযোগ। একথা আমি দ্বীনের ভিত্তিতে নয়, চিন্তা ওগবেষণার ভিত্তিতে বলছি। মানুষের বুদ্ধি-বিবেক যখন দাবি করে, সব বিষয়েই সে জেনে ফেলেছে, কোন জিনিসই তার জানার বাইরে নেই, তখন নিজেই তার সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট করে ফেলে। বুদ্ধি নিজেই জানে না সে কি জিনিস। কাজেই সে মানসিক ধারণার বিমূরত বিষয়সমূহ উপলব্ধি করবে কিভাবে? এর অর্থ এই নয় যে, আমি মানুষের বুদ্ধি-বিবেক ও স্বাধীনতার গুরুত্বকে অস্বীকার করছি। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাকে ততোটুকু মর্যাদা দেয়া উচিত যতোটুকু তার পাওনা।

ইউরোপের ধার্মিকগোষ্ঠী বস্তুবাদী দুনিয়ায় বসবাস করা সত্ত্বেওবুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় স্বাধীন মতামত প্রদান পছন্দ করতেন না। প্রতিক্রিয়া তার এই হয়েছে যে, বুদ্ধিজীবি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য আমরাএ বিষয়টিকে প্রাচৗ ইসলাম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতেচাই না। কেননা এরূপ স্বাধীন চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ অন্যদের ওপর বিনা দলিলেই প্রভাব বিস্তার করে বসবে যাকে আমরা নিন্দনীয় তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণ বলতে পারি। এ থেকে বুজা যায়, চিন্তার স্বাধীনতা বন্ধুত্বের একটি পন্থা। সেই বন্ধুত্বের সুবাদে আমরা বানরের মতো অপরের অনুকরণ করেই চলছি।

এতে কোন সন্দেহ নেই, যারা ‘আল-কুরআনের ঘটনাবলী এবং কুরআনে আঁকা কিয়ামতের চিত্র’ নিয়ে চিন্তা ও অনুসন্দান করছিল তারা আমার মতোই বাধাগ্রস্তহয়েছেন। আমি ভাবতাম, আল-কুরআনে যেসব দৃশ্যের চিত্রায়ণ করা হয়েছে, তা কি এভাবেই সংঘটিত হয়েছে? নাকি তা উপমা আকারে বর্ণিত হয়েছে?

দীর্ঘদিন আমিএ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি কিন্তু ঐতিহাসিক এমন একটি ঘটনাও পাইনি যার ওপর আমার অকাট্যভাবে বিশ্বাস স্থাপন হয় এবং আমি কুরআনের সাথে সেগুলো তুলনা করবো, তার চিন্তাও করতে পারিনি যে, শুধু ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে কোন ঘটনা কুরআনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। তখন এমন একজন দ্বীনদারও ছিলেন না, দ্বীনি বিষয়ে আমাকে খোলামেলা আলাপ করার ব্যাপারে নিষেধ করবে। পক্ষান্তরে আমি এতোটুকু বুঝতে পারতাম যে, আমার কথাগুলোকে কেউ যেন মিথ্যের ওপর ভিত্তি বলে উড়িযে দিতে না পারেন।

যদি কোন ব্যক্তি এমন কোন সতপেয়ে যান যাকে কুরআনের সাথে তুলনা করা চলে তাহলে আমি শান্ত মনে তার কথা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে তৈরী আছি। কিন্তু এমন সত্য অনুসন্ধানের আগে যদি এক ভিত্তিহীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমার এ পুস্তককে মিথ্যে প্রতিপন্ন করা হয়, তা হবে স্বল্পবুদ্ধির পরিচায়ক। দ্বীনিমর্যাদায় আমার এ পুস্তকের মান যা-ই হোক না কেন।

কুরআনী পরিভাষার আলোকে বিরল বক্তব্য, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সৌন্দর্য এবং শক্তিশালী বর্ণনার নাম ‘শিল্পকলা’। তার মধ্যে কোন কিছুই একতার দাবি করে না যে, সে সবের ভিত্তি শুধু অলীক চিন্তা-কল্পনার ও তার প্রতিষ্ঠিত করা যায়।তবে শর্ত হচ্ছে- ব্যক্তির মধ্যে দৃঢ়তা, বুঝ ও উপলব্ধি যদি যথাযথভাবে থাকে।

পরিশিষ্ট-২

আল-কুরআনের সূরা অবতীর্ণের ক্রমধারা

সূরার নাম অবতীর্ণক্রম সংকলন ক্রম
সূরা আল-আলাক/ সূরা ইকরা বিইস্‌মি ০১ ৯৬
সূরা আল-মুজ্জাম্মিল ০২ ৭৩
সূরা আল-মুদ্দাস্‌সির ০৩ ৭৪
সূরা আল-কলম ০৪ ৬৮
সূরা আল-ফাতিহা/আস সাবাউল মাছানী ০৫ ০১
সূরা লাহাব/ সুরা মাসা ০৬ ১১১
সূরা আত-তাভীর ০৭ ৮১
সূরা আল-আ’লা ০৮ ৮৭
সূরা আল-লাইল ০৯ ৯২
সূরা আল-ফাযর ১০ ৮৯
সূরা আদ-দোহা ১১ ৯৩
সূরা ইনশিরাহ/ সূরা আলাম নাশরাহ/ সূরা আশ শর্‌হ ১২ ৯৪
সূরা আল-আর ১৩ ১০৩
সূরা আল-আদিয়াত ১৪ ১০০
সূরা আল-কাওছার ১৫ ১০৮
সূরা আত-তাকাছর ১৬ ১০২
সূরা আল-মাউন ১৭ ১০৭
সূরা আল-কাফিরূন ১৮ ১০৯
সূরা আল-ফীল ১৯ ১০৫
সূরা আল-ফালাক ২০ ১১৩
সূরা আল-নাস ২১ ১১৪
সূরা আল-ইখলাস ২২ ১১২
সূরা আবাস ২৪ ৮০
সূরা আল-কাদর ২৫ ঙ৯৭
সূরা আশ-শাস্‌স ২৭ ৮৫
সূরা আত্‌তীন ২৮ ৯৫
সূরা কুরাইশ ২৯ ১০৬
সূরা আল-ক্বারিয়াহ ৩০ ১০১
সূরা আল-ক্বিয়ামাহ ৩১ ৭৫
সূরা আল-হুমাযা ৩২ ১০৪
সূরা আল-মুরসালাত ৩৩ ৭৭
সূরা ক্বাফ ৩৪ ৫০
সূরা আল-বালাদ ৩৫ ৯০
সূরা আত্‌-ত্বারিক ৩৬ ৮৬
সূরা আল-ক্বামার ৩৭ ৫৪
সূরা সাদ ৩৮ ৩৮
সূরা আল-আ’রাফ ৩৯ ০৭
সূরা জ্বিন ৪০ ৭২
সুরা ইয়াসীন ৪১ ৩৬
সূরা আল-ফুরক্বান ৪২ ২৫
সূরা ফাতির ৪৩ ৩৫
সূরা মারইয়াম ৪৪ ১৯
সূরা ত্ব-হা ৪৫ ২০
সূরা ওয়াকিয়া ৪৬ ৫৬
সূরা আশ-শুয়ারা ৪৭ ২৬
সূরা আন-নামল ৪৮ ২৭
সূরাক্বাসাস ৪৯ ২৮
সূরা বানী ইসরাঈল/সূর আসরা ৫০ ১৭
সূরা ইউনুস ৫১ ১০
সূরা হুদ ৫২ ১১
সূরা ইউসুফ ৫৩ ১২
সুলা আল-হিযর ৫৪ ১৫
সূরা আনআম ৫৫ ০৫
সূরা আস্‌-সাফ্‌ফত ৫৬ ৩৭
সূরা ‍লুকমান ৫৭ ৩১
সূরা আস-সাবা ৫৮ ৩৪
সূরা আয্‌-যুমার ৫৯ ৩৯
সূরা আল-মুমিন/সূরা গাফির ৬০ ৪০
সূরা হা-মীম আস্‌সাজদা/সূরা ফুস্‌সিলাত ৬১ ৪১
সূরা আশ-শুরা ৬২ ৪২
সূরা যুখরুফ ৬৩ ৪৩
সূরা আদ-দুখান ৬৪ ৪৪
সূলা আল-জাছিয়া ৬৫ ৪৫
সূরা আহকাফ ৬৬ ৪৬
সূরা আয-যারিয়াত ৬৭ ৫১
সূরা আল-গাশিয়া ৬৮ ৮৮
সূরা আল-কাহফ ৬৯ ১৮
সূরা আন-নাহল ৭০ ১৪
সূরা নূহ ৭১ ৭১
সূরা ইবরাহীম ৭২ ১৪
সূরা আল-আম্বিয়া ৭৩ ২১
সূলা মুমিনূন ৭৪ ২৩
সূরা আস্‌-সাদজাহ ৭৫ ৩২
সুরা আত-তূর ৭৬ ৫২
সূরা আল-মুলক ৭৭ ৬৭
সূরা আল-হাক্কাহ্‌ ৭৮ ৬৯
সূলা আল-মাআরিজ ৭৯ ৭০
সূরা আন-নাবা ৮০ ৭৮
সূরা আন-নাযিয়াত ৮১ ৭৯
সূরা ইনফিতর ৮২ ৮২
সূরা ইনশিক্বাক ৮৩ ৮৪
সূরা আর-রূম ৮৪ ৩০
সূরা আল-আনকাবূত ৮৫ ২৯
সূরা আল-মুতাফ্‌ফিফীন ৮৬ ৮৩
সূরা আল-বাকারাহ ৮৭ ০২
সূরা আল-আনফাল ৮৮ ০৮
সূরা-আলে ইমরান ৮৯ ০৩
সূরা আল-আহযাব ৯০ ৩৩
সূরা মুমতাহিনা ৯১ ৬০
সূরা আন-নিসা ৯২ ০৪
সূলা যিলযাল ৯৩ ৯৯
সূরা আল-হাদীদ ৯৪ ৫৭
সূরা মুহাম্মদ/ সূরা কিতাল ৯৫ ৪৭
সূরা আর্‌-রা’দ ৯৬ ১৩
সূরা আর-রহমান ৯৭ ৫৫
সূরা দাহর/সুরা ইনসান ৯৮ ৭৬
সূর আত্‌-তালাক ৯৯ ৬৫
সূরা বাইয়্যিনাহ ১০০ ৯৮
সূরা আল-হাশর ১০১ ৫৯
সূরা আন-নূর ১০২ ৩৪
সূলা আল-হাজ্জ ১০৩ ২২
সূরা আল-মুনাফিকূন ১০৪ ৬৩
সূরা আল-মুজাদাহলাহ ১০৫ ৫৮
সূরা আল-হুজরাত ১০৬ ৪৯
সূলা আত-তাহরীম ১০৭ ৬৬
সূলা আত্‌-তাগাবুন ১০৮ ৬৪
সূরা আছ-সফ ১০৯ ৬১
সূরা আল-জুম’আ ১১০ ৬২
সূরা আল-ফাত্‌হ ১১১ ৪৮
সূরা আল-মায়িদা ১১২ ০৫
সূরা আত্‌-তওবা/সূলা বারায়াত ১১৩ ০৯
সূলা আন-নাসর ১১৪ ১১০