al_quraner_shoilpik_soundorjo

অষ্টম অধ্যায়

প্রসঙ্গঃ আল কুরআনের বর্ণিত ঘটনাবলী

একথা স্মরণ রাখা উচিত যে, কিস্‌সা-কাহিনী বর্ণনা করা আল-কুরআনের মূল উদ্দেশ্য নয়। যদিও এর মধ্যে সেই বিসয়বস্তু এবং স্টাইল অবলম্বন করা হয়, যা গল্প-উপন্যাস লেখার জন্য অপরিহার্য। গল্প-উপন্যাস লেখার সেই শৈল্পিক দিকটি অনুসরণ করা আমাদের একান্ত প্রয়াজন। কিন্তু এখানকার ব্যাপারটি কিছুটা ভিন্ন।আল-কুরআন দ্বীনি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আনুসঙ্গিক যেসব উপকরণ গ্রহণ করেছ ঘটনাবলী সেসব উপকরণের অন্যতম একটি উপকরণ। কুরআনর মূল লক্ষ্য হচ্ছে দাওয়াতে দ্বীন এবং কাহিনী চিত্র হচ্ছে ঐ দাওয়াতকে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় মানুষের নিকট পৌঁছানোর একটি মাত্র। কুরআন যে উদ্দেশ্যে কিয়ামত ও আখিরাতে সওয়াবের চিত্র তুলে ধরেছে, যে উদ্দেশ্যে মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের তথ্য পেশ করেছে, যে উদ্দেশ্যে শরীয়তের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য উদাহরণ উপমা বর্ণনা করেছে, ঠিক সেই একই উদ্দেশ্যে কাহিনী চিত্রও উপস্থাপন করেছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বীনি দাওয়াতকে মানুষের নিকট হৃদয়গ্রাহী করে পৌঁছে দেয়া।

সত্যি কথা বলতে কি, কুরআনে বর্ণিত ঘটনাবলী ও তার বিষয়বস্তু নিজস্ব স্টাইলে এবং নিখুঁতভাবে দ্বীনি উদ্দেশ্যকে পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে পৌছে দিয়েছে। (সামনে আমরা তার ধরন ও নমুনা বর্ণনা করবো।) তাই বলে দ্বীনি উদ্দেশ্যের অধীন হওয়ার অর্থ এই নয় যে, ঘটনাবলী উপস্থাপনের সময় শৈল্পিক দিকটির প্রতি লক্ষ্যই রাখা হবে না। বরং ঘটনাবলী দ্বীনি উদ্দেশ্যকে পুরো করার সাথে সাথে শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যসমূহও ধারণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে আল-কুরআনের বর্ণনা ও উপস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণিই হচ্ছে চিত্রায়ণ। মযা বর্ণনার অপরিহার্য বিশেষ।

ইতোপূর্বে আমরা বলেছি আল-কুরআনের প্রতিটি নিয়ম দ্বীনি ও শৈল্পিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরিপূরক। আল-কুরআনে উপস্থাপিত প্রতিটি ছবি ও দৃশ্য উভয় গুণেই গুণান্বিত্ আমরা আরও বলেছিলাম, আল-কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য মানুষের মনোজগতের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ মনোজগতের সেই দ্বীনি অনুভূতিকে শৈল্পিক সৌন্দর্যের ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, দ্বীন এবং শৈল্পিকতা একে অপরের পরিপূরক এবং তার অবস্থান মানুষের মনের গভীরে। সে জন্য মানুষের বিবেক তখনিই তা গ্রহণ করে যখন শৈল্পিক সৌন্দর্য সর্বোচ্চ চূড়ায় গিয়ে উপনীত হয় এবং তার সাথে সাথে মান ও মানস সেই সৌন্দর্য সুষমার আহবানে সাড়া দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে।

আমরা ‘শৈল্পিক চিত্র’ অধ্যায়ে কাহিনী চিত্রের দুটো উদাহরণ পেশ করেছি। সেখানে প্রকৃতি তার তুলি দিয়ে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ছবি এঁকেছ। যা মানুষকে প্রভাবিত না করে পারে না। আমরা সেখানে এর বিস্তারিত আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। এখন আমরা সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের চেষ্টা করবো। ইনশা আল্লাহ।

আল-কুরআনে বর্ণিত ঘটনাবলীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

আমরা পূর্বে বলেছি, একমাত্র দ্বীনি উদ্দেশ্যকে পূর্ণতার দ্বারপ্রান্ত পৌঁছে দেয়া লক্ষ্যেই আল-কুরআনে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। সেই দ্বীনি উদ্দেশ্যকে পূর্ণ করার জন্যই ঘটনাসমূহ বর্ণনা করেছে। যমন ওহী ও রিসালাতের স্বীকৃতি, তাওহীদ, বিভিন্ন নবীদের দ্বীন এক, সমস্ত নবীদের সাথে আচরণের পদ্ধতি এক ও অভিন্ন, কুদরতের বহিঃপ্রকাশ, ভাল ও মন্দের পরিণতি, ধৈর্য ও স্থৈর্য, শোর ও কুফর এবং আরো অনেক উদ্দেশ্যকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য কুরআন কাহিনী চিত্রের সাহায্য নিয়েছে।

১. ওহী ও রিসালাতের স্বীকৃতি: আমরা আল-কুরআনে বর্ণিত ঘটনাবলীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করবো। তার পরিধি ও বিস্তৃতিকে করায়ত্ব করার জন্য নয়। আল-কুরআনে ঘটনাবসমূহ বর্ণনা করার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ওহী ও রিসালাতের স্বীকৃতি এবং তার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের যুক্তি উপস্থাপন করা।

উল্লেখ্য যে, নবী করীম (স) প্রচলিত অর্থে কোন লেখাপড়া জানতেন না। এমনকি ইহুদী কিংবা খ্রীস্টান কোন আলিমের সাথেও তাঁর কোন সম্পর্ক ছিল না। যাতে তিনি কুরআনের মাধ্যমে এমন কিছু ঘটনা বর্ণনা করতে পারেন। অনেক ঘটনাতো তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন আবার কোন কোনটি আংশিক যেমন, হযরত ইবরাহীম (আ), হযরত ইউসুফ (আ), হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা। কুরআনে এসব ঘটনার আলোচনা একথাই প্রমাণ করে যে, এগুলো তাঁকে ওহীর মাধ্যমে জানান হয়েছে। কুরআন তো এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে। যেমন সূরা ইউসুফের শুরুতেই বলা হয়েছে।

(আরবী**********) আমি এ কুরআনকে আরবীতে অবতীর্ণ করেছি যেন তোমরা বুঝতে পার। (সূরা ইউসুফ: ২)

(আরবী**********)

আমি তোমার নিকট একটি উত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছি, যেভাবে আমি এ কুরআনকে তোমার নিকট অবতীর্ করেছি। অবশ্য তুমি এর পূর্বে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। (সূরা ইউসুফ: ৩)

সূরা কাসাসে হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা বর্ণনার পূর্বে বলা হয়েছে:

(আরবী**********) আমি তোমার কাছে মূসা ও ফিরাউনের ঘটনাবলী যথাযথভাবে বর্ণনা করছি ইমানদার সম্প্রদায়ের জন্য (সূরা আল-কাসাস: ৩)

যেখানে এ ঘটনা শেষ হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে:

(আরবী**********)

মূসাকে যখন আমি নির্দেশ দিয়েছিলা, তুমি পশ্চিম প্রান্তে ছিলে না এবং তা প্রত্যক্ষও করনি। কিন্তু আমি অনেক জাতি সৃষ্টি করেছিলাম এবং তাদের অনেক যুগ অতিবাহিত হয়েছে। আর তুমি মাদইয়ানবাসীদের মধ্যেও ছিলে না, যখন তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো। কিন্তু আমিই ছিলাম রাসল প্রেরণকারী। আমি যখন মূসাকে আওয়াজ দিয়েছিলা, তখন তুমি তুর পর্বতের পাশে ছিলে না। কিন্তু এটি তোমার পালনকর্তার রহমত স্বরূপ। যাতে তুমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে ভীতি প্রদর্শন করতে পার, যাদের কাছে ইতোপূর্বে আর কোন ভীতি প্রদর্শনকারী আসেনি। যেন তা স্মরণ রাখে। (সূরা আল-কাসাস: ৪৪-৪৬)

হযরত মারইয়াম (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয় সূরা আলে-ইমরানে বলা হয়েছে:

(আরবী**********)

এ হলো গায়েবী সংবাদ যা আমি তোমাকে প্রদান করে থাকি। আর তুমিতো সে সময় ছিলে না যখন তারা প্রতিযোগিতা করছিল, কে মরিয়মের অভিভাবকত্ব লাভ করবে। আর তখনও তুমি ছিলে না যখন তারা ঝগড়া-বিবাদ করছিল। (সূরা আলে ইমরান: ৪৪)

হযরত আদম (আ)-এর ঘটনা বর্ণনার পূর্বে সূরা সা’দ-এ বলা হয়েছে:

(আরবী**********) বলো, এটি এক মহাসংবাদ, যা থেকে তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ। ঊর্ধ্বজগত সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান ছিল না, যখন ফেরেশতারা কথাবার্তা বলছি। আমার কাছে এ ওহী-ই আসে যে, আমি একজন স্পষ্ট সতর্ককারী। (সূরা সা’দ : ৬৭-৭১)

সূরা হুদে নূহ (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে:

(আরবী**********)

এটি গায়েবের খবর, আমি তোমাকে ওহীর মাধ্যমে জানাচ্ছি। ইতোপূর্বে এটি তোমার ও তামার জাতির জানা ছিল না। (সূরা হুদ: ৪৯)

২. এক ও অভিন্ন দ্বীন: আল-কুরআনে একথা সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, সকল দ্বীন-ই আল্লাহর থেকে প্রাপ্ত। ঈমানদারগণ এক উম্মত বা দল। আর আল্লাহর সবার প্রতিপালক। আল-কুরআনের অনেক জায়গায় বিভিন্ন নবীদের ঘটনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। সমস্ত নবীদের দ্বীনও যে এক এবং অভিন্ন একথা বলাও ইসলামের দাওয়াতের উদ্দেশ্য। এজন্য সামান্য রদবদল করে নবীদের কাহিনী আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়েছে। যেন মানুষ বুঝতে পারে, সমস্ত নবী ও রাসূলগণ একই দায়িত্ব নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন। নিচে আমরা কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। ইরশাদ হচ্ছে:

(আরবী**********)

আমি মূসা ও হারুনকে দান করেছিলাম মীমাংসাকারী গ্রন্থ আলো ও উপদেশ, আল্লাহভীরুদের জন্য। যারা না দেখেই তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে এবং কিয়ামতের ভয়ে শংকিত হয়। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৪৮-৪৯)

(আরবী**********)

এট কল্যাণকর নসীহ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি, তবু কি তোমরা তা অস্বীকার করবে? আর আমি ইতোপূর্বে ইবরাহীমকে সত্যাশ্রয়ী করেছিলাম এবং আমি তার সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। যখন সে তাঁর পিতা ও সম্প্রদায়কে জিজ্ঞেস করেছিল। এ মূর্তিগুলো কী, তোমরা যাদের পূজারী হয়ে বসে আছ? (সূরা আল-আম্বিয়া: ৫১-৫২)

(আরবী**********)

আমি তাকে (ইবরাহীম) ও লুতকে উদ্ধার করে সেই দেশে পৌঁছে দিলাম, যেখানে আমি বিশ্বের জন্য কল্যাণ রেখেছি। আমি তাকে দান করলাম ইসহাক এবং পুরষ্কার স্বরূপ দিলাম ইয়াকুবকে এবং প্রত্যেককে সৎকর্মশীল বানালাম। আমি তাদেরকে নেতা করলাম। তারা আমার নির্দেশ অনুযায়ী পথ প্রদর্শন করতো। আমি তাদের প্রতি ওহী নাযিল করতাম- সৎকাজ করার, নামায কায়েম করার ও যাকাত আদায়ের জন্য। তারা আমার ইবাদতে মশগুল ছিল। (সূরা আম্বিয়া: ৭১-৭৩)

(আরবী**********)

এবং আমি লুতকে দিয়েছিলাম পজ্ঞা ও জ্ঞান। আর তাকে এ জনপদ থেকে উদ্ধার করেছিলাম। যারা নোংরা কাজে লিপ্ত ছিল। তারা মন্দ ও নাফরমান সম্প্রদায় ছিল। আমি তাকে আমার অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। সে ছিল সৎকর্মশীলদের একজন।

(আরবী**********)

এবং স্মরণ কর নূহকে, যখন সে এর পূর্বে দো’আ করেছিল এবং আমি তার দো’আ কবুল করেছিলাম। তারপর তাঁকে ও তাঁর পরিবারবর্গকে মহাসংকট থেকে উদ্ধার করেছিলাম। আমি তাকে ঐ সম্প্রদায়ের বিপক্ষে সাহায্য করেছিলাম, যারা আমার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করেছিল। নিশ্চয়ই তারা ছিল দুষ্ট সম্প্রদায়; এজন্য তাদের সকলকে ডুবিয়ে মেরেছিলাম। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৭৬-৭৭)

(আরবী**********)

এবং স্মরণ কর দাউদ ও সুলাইমানকে, যখন তারা শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করছিল। সেখানে রাতে কিছু লোকের মেষ ঢুকে পড়েছিল, তাদের বিচার আমার সামনে ছিল। অতপর আমি সুলাইমানকে সে ফয়সালা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম এবং উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়েছিলাম্ আমি পর্বত ও পাখীকূলকে দাঊদের অনুগত করে দিয়েছিলা, তারা আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতা। এ সমস্ত আমিই করেছিলাম। আমি তাকে তোমারেদ জন্য বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা তোমাদেরকে যুদ্ধে রক্ষা করে। তবে কি তোমরা কৃতজ্ঞ হবে? (সূরা আল-আম্বিয়া: ৭৮-৮০)

(আরবী**********)

আর সুলাইমানের অধীন করেছিলাম প্রবল বায়ুকে। তা তার আদেশে প্রবাহিত হতো ঐ দেশের দিকে যেখানে আমি কল্যাণ দান করেছিলাম। আমি সব বিষয়েই সম্যক অবগত আছি। আর অধীন করে দিয়েছিলাম শয়তানদের কতককে যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করতো। এছাড়া অন্য আরো অনেক কাজ করতো। আমি তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতাম। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৮১-৮২)

(আরবী**********)

স্মরণ করো আইউবের কথা যখন সে তার পালনকর্তাকে আহ্বান করে বললো: ‘আমি দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চেয়ে সর্বশ্রেস্ঠ দয়াবান’। আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম এ বং তার দুঃখ-কষণ্ট দূর করে দিলাম। আর তার পরিবারবর্গকে ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সাথে তার সমপরিমাণ আরো দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশত। বস্তুত এটি ইবাদতকারীদের জন্য একটি স্মারক। (সূরা আম্বিয়া: ৮৩-৮৪)

(আরবী**********)

আর ইসমাঈল, ইদ্রিশ ও যুলকিফ্‌লের কথা স্মরণষ করো, তারা প্রত্যেকেই ছিল সবরকারী। আমি তাদেরকে আমার রহমত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। তারা সবাই ছিল সৎকর্মশীল। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৮৫-৮৬)

(আরবী**********)

এবং মাছওয়ালার কথা স্মরণ করো, সে ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিল আর মনে করেছিল যে, আমি তাকে পাকড়াপও করতে পারবো না। অতপর সে অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করলো, ‘তুমি চাড়া কোন ইলাহ নেই, তুমি নির্দোষ আমি গুনাহগার, তারপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। এমনিভাবে বিশ্বাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকে। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৮৭০-৮৮)

(আরবী**********)

এবং যাকারিয়ার কথা স্মরণ করো, যখন সে তার পালনকর্তাকে আহ্বান করেছিল: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একা রেখ না। তুমি তো উত্তম ওয়ারিশ। অতপর আমি তার দো’আ কবুল করেছিলাম, তাকে দান করেছিলাম ইয়াহ্‌ইয়কে এবং তার জন্য তার স্ত্রীকে সন্তান ধারণের যোগ্য বানয়ে দিয়েছিলাম, তারা সৎকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তো, তারা আশা ও ভীতি সহকারে আমাকে ডাকতো এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত।

(আরবী**********)

এবং সেই নারীর (অর্থাৎ মারইয়ামের) কথা স্মরণ করো, যে তার কাম-প্রবৃত্তিকে বশে রেখেছিল, অতপর আমি তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং তাকে ও তার পুত্রকে বিশ্বাসীর জন্য নিদর্শন বানিয়েছিলা। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৯১)

(আরবী**********) তারা সকলেই তোমাদের দ্বীনের-একই দ্বীনে বিশ্বাসী এবং আমি তোমাদের পালনকর্তা, অতএব আমার ইবাদত করো।

আল-কুরআনের কিস্‌সা-কাহিনী বর্ণনা করার আসল উদ্দেশ্য এটিই। এছাড়া আর যতো উদ্দেশ্য আছে তা মুখ্য নয় গৌণ।

৩. আল্লাহর ওপর ঈমান : আল-কুরআনে কাহিনী বর্ণনার উদ্দেশ্য শুধু এই নয় যে, সমস্ত দ্বীন লা-শরীক এক আল্লাহর নিক থেকে এসেছে একথা প্রমাণ করা; বরং একথাও প্রমাণ করা যে, এ সবগুলো দ্বীনের ভিত্তিও এক। সব নবীদের কাহিনী একত্রিত করলে বুঝা যায়, তাদের সর্বপ্রথম দাওয়াত ছিল ঈমান বিল্লাহ বা আল্লাহর ওপর ঈমানের। যেমন : সূরা আল-আ’রাফে বলা হয়েছে:

(আরবী**********)

নিশ্চয়ই আমি নূহকে তাঁর জাতির কাছে পাঠিয়েছি। সে বললো: হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা আল্লহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। আমি তোমাদের জন্য এক কঠিন দিবসের শাস্তির আশঙ্কা করি। (সূরা আল-আ’রাফ: ৫৯)

(আরবী********)

আদ জাতির কাছে তাদের ভাই হুদকে পাঠিয়েছি। সে বললো: হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কি ভয় করবে না?

(আরবী**********)

সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই সালেহকে। সে বললো: হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন উপাষ্য (ইলাহ) নেই। তোমাদের নিকট তোমাদের রব্ব-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে গেছে।

(আরবী***********)

আমি মাদইয়ানবাসীর জন্য তাদের ভাই শু’আইবকে পাঠিয়েছি, সে বললো: হে আমার জাতির লোকেরা! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। (সূরা আল-আ’রাফ: ৮৫)

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইসলামী আকীদাসমূহের মধ্যে তাওহীদ হচ্ছে মূল বা ভিত্তি। আর সমস্ত আম্বিয়ায়ে কিরামই তাওহীদের মুবাল্লিগ ছিলেন। যেহেতু তাদের সকলের উদ্দেশ্য ছিল এক তাই তাদের ঘটনাবলীর মধ্যেও সামঞ্জস্য দেখা যায়।

৪. সমস্ত নবী-রাসূল একই পদ্ধতিতে দাওয়াত দিয়েছেন: ওপরে আলোচনা থেকেও একথা বুঝা যায় যে, প্রত্যেক নবীর দাওয়াতের পদ্ধতি ছিল এক ও অভিন্ন। আর প্রত্যেক নবীর জাতি তাদের সাথে যে আচরণ করেছে তাও প্রায় একই রকম। কারণ, সকল নবীর দ্বীন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এবং সকল দ্বীনের ভিত্তিও এক। এ কারণেই নবীদের কাহিনীগুলো অধিকাংশ জায়গায় একত্রে এসেছে এবং তাদের একই ধরনের কার্যকলাপের বিবরণ বার বার পেশ করা হয়েছে। যেমন সূরা হুদে বলা হয়েছে:

(আরবী**********)

অবশ্যই আমি নূহকে তাঁর জাতির কাছে পাঠিয়েছিলাম। (সে জাতিকে বললো:) নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সতর্ককারী। তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না। কেননা আমি তোমাদের ব্যাপারে এক যন্ত্রণাদায়ক দিনের শান্তির ভয় করছি। তখন তার সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসী গোত্রপতি ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বললো: আমরা তো তোমাকে আমাদের মতো একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই মনে করি না। আর আমাদের মধ্যে যারা নিঃস্ব ও নির্বোধ তারা ছাড়া আর কাউকে তোমার আনুগত্যও করতে দেখি না। তাছাড়া আমারেদ ওপর তোমার কোন প্রাধান্যও নেই বরং তোমাকে আমরা মিথ্যেবাদী মনে করি।

নূহ (আ) বললেন: (আরবী***********)

হে আমার জাতির লোকেরা! তোমাদের কাছে কোন ধন-সম্পদ চাই না। আমি একমাত্র আল্লাহর নিকটই আমার পারিশ্রমিক চাই। (সূরা হুদ: ২৯)

নূহ (আ)-এর জাতি বললো:

(আরবী***********)

হে নূহ! আমাদের সাথে তুমি তর্ক করছ এবং অনেক ঝগড়া-বিবাদ করছ। এখন তুমি তোমার সেই আযাব নিয়ে এসো, যে সম্পর্কে তুমি আমাদেরকে সতর্ক করছ। যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাক। (সূরা হুদ: ৩২)

(আরবী***********)

আর আ’দ জাতির প্রতি তাদের ভাই হূদকে পাঠিয়েছি, সে বললো:” হে আমার জাতির লোরো! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ভিন্ন তোমাদের আর কোন মা’বুদ নেই। তোমরা সবাই মিথ্যারোপ করছ। হে আমার জাতি! আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না, আমার পারিশ্রমিক তো তাঁর কাছেই, যনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তবু তোমরা কেন বুঝ না? হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করো। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের শক্তি উত্তর-উত্তর বৃদ্ধিথ করবেন। তোমরা কিন্তু অপরাধীদের মতো হয়ো না। তারা বললো: হে হূদ! তুমি আমাদের নিকট কোন প্রমাণ নিয়ে আসনি, কাজেই আমরা তোমার কথায় আমাদের দেব-দেবীদের বর্জন করতে পারি না। আর আমরা তোমাকে বিশ্বাস করতেও পারি না। বরং আমরা মনে করি তোমার ওপর আমাদের কোন দেবতার মার পড়েছে। হূদ বললো: আমি আল্লাহকে সাক্ষী করছি এবং তোমরাও সাক্ষী থাক, আমার কোন সম্পর্ক নেই তাদের সাথে যাদেরকে তোমরা শরীক করছ। তাঁকে ছাড়া। তোমরা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট করার প্রয়াস চালও, অতপর আমাকে কোন অবকাশ দিয়ো না। (হূদ : ৫০-৫৫)

(আরবী***********)

আর সামুদ জাতির প্রতি তাদের ভাই সালেহকে পাঠিয়েছিলাম। সে বললো: হে আমার জাতি! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন উপাস্য নেই। তিনি জমিন থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার মধ্যেই তোমাদেরকে বসবাস করাচ্ছেন। অতএব, তাঁর কাছে মাফ চাও এবং তাঁর দিকেই ফিরে চল। আমার পালনকর্তা নিকটেই আছেন, কবুল করে থাকেন সন্দেহ নেই। তারা বললো: হে সালেহ! ইতোপূর্বে তোমার নিকট আমাদের বড় আশা ছিল। আমাদের বাপ-দাদা যাদের পূঁজা করতো, তুমি তা থেকে আমাদেরকে বারণ করছ? কিন্তু যার প্রতি তুমি আমাদেরকে আহ্বান করছ, তাতে আমাদের এমন সন্দেহ রয়েছে যে, মন মোটিই সায় দিচ্ছে না। (সূরা হুদ: ৬১-৬২)

৫. প্রত্যেক নবী-রাসূলদের দ্বীনের যোগসূত্র: আল-কুরআনে কাহিনী বর্ণনার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে নবী করীম (স)-এর দ্বীন এবং হযরত ইবরাহীম (আ)সহ অতীতের সকল নবীর দ্বীন যে একই সূত্রে বাধা। বিশেষ করে বনী ইসরাঈল ও উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে দ্বীনের যোগসূত্র অন্যাস্য নবীর দ্বীনের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী তা প্রমাণ করা। এজন্য আল-কুরআনের যেখানে হযরত ইবরাহীম (আ), হযরত ঈসা (আ)-এর ঘটনাগুলো বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন:

(আরবী***********) এটি লিখিত আছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে, (বিশেষ করে) ইবরাহীম ও মূসার কিতাবে। (সূরা আল-আ’লা: ১৮-১৯)

(আরবী***********)

তাকে কি জানান হয়নি, যা আছে মূসার কিতাবে এবং ইবরাহীমের কিতাবে, যে তার দায়িত্ব পালন করেছিল? কিতাবে এই আছে যে, কোন ব্যক্তি কারো গুনাহ নিজে বহন করবে না। (নাজম: ৩৬-৩৮)

(আরবী***********)

মানুষের মধ্যে যারা ইবরাহীমের অনুসরণ করেছিল তারা আর এই নবী এবং যারা এ নবীর প্রতি ঈমান এনেছে তারা ইবরহাীমের ঘনিষ্ঠতম। আর আল্লাহ হচ্ছেন মুমিনদের বন্ধু। (সূরা আলে ইমরান: ৬৮)

(আরবী***********) তোমাদের জাতির পিতা ইবরাহীম। তিনিই তোমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন। (সূরা আল-হাজ্জ: ৭৮)

(আরবী***********)

আমি তাদের পেছনে মারইয়াম তনয় ঈসাকে পাঠিয়েছি। সে পূর্ববর্তী তওরাত গ্রন্থের সত্যায়নকারী ছিল। আমি তাকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়েত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়ন করে, পথ প্রদর্শন করে এবং এটি আল্লাহভীরুদের জন্য হেদায়েত ও উপদেশ বাণী। ইঞ্জিলের অধিকারীদের উচিত আল্লাহ তাতে যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী ফয়সালা করা। যারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারা পাপাচারী। আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি। সত্যগ্রন্থ। যা পূর্বে অবতীর্ণ গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। (সূরা আল-মায়েদা: ৪৬-৪৮)

৬. নবী-রাসূলদের সফলতা ও মিথ্যেবাদীদের ধ্বংস: আল-কুরআনে কাহিনী বর্ণনার আরেক উদ্দেশ্য হচ্ছে আম্বিয়ায়ে কিরামের সফলতা ও মিথ্যেবাদীদের ধ্বংসের কথা তুলে ধরা। যেন তা নবী করীম (স)-এর জন্য সান্ত্বনার কারণ এবং তাদের জন্যও সান্ত্বনা এবং আদর্শ হয় যারা ঈমানের পথে লোকদেরকে আহ্বান করে। ইরশাদ হচ্ছে:

(আরবী***********)

আমি নবী-রাসূলদের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলেছি, যা দিয়ে তোমার অন্তরকে মজবুত করেছি। আর এভাবে তোমার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসীহম ও স্মারক এসেছে। (সরা হুদ : ১২০)

কুরআন মজীদে যেখানেই নবীদের কথা ও তাদের সফলতার কথা বলা হয়েছে, তার পরটপরই ঐ সমস্ত কাফির মুশরিকদের পরিণতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যারা নবীদেরকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করতো। যেমন:

(আরবী***********)

আমি নূহকে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছিলাম। সে সাড়ে নয়শ বছর তাদের সাথে ছিল। তারপর তাদেরকে মহাপ্লাবনে এসে ধ্বংস করে দিলো কেননা তারা ছিল পাপী। অতপর আমি নূহকে ও নৌকার আরোহীদেরকে বাঁচিয়ে দিলাম এবং নৌকাটিকে বিশ্ববাসীর জন্য নিদর্শন বানিয়ে রাখলাম।

(আরবী***********)

স্মরণ করো ইবরাহীমকে। যখন সে তার সম্প্রদায়কে বললো: তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাকে ভয় করো। এটিই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ। (সূরা আল-আনকাবুত: ১৬)

(আরবী***********)

আমি লূতকে পাঠিয়েছিলাম। যখন সে তার জাতিকে বললো: তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করছ যা তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ করোনি। তোমরা কি সমকামে লিপ্ত হচ্ছো, রাহাজানি করছ এবং নিজেদের মজলিসে গর্হিত কর্ম করছ? তার জবাবে তাঁর জাতি কেবল একথা বললো: আমাদের ওপর আল্লাহর আযাব আনো যদি তুমি সত্যবাদী হও।….. যখন প্রেরিত ফেরেশতাগণ লূতের কাছে পৌঁছল তখন তাদের কারণে সে বিষণ্ণ হয়ে পড়ল এবং তার মন সংকীর্ণ হয়ে গেল। তারা বললো: ভয় করবেন না এবং দুঃখ করবেন না, আমরা আপনাকে ও আপনার পরিবারবর্গকে রক্ষা করবোই, শুধু আপনার স্ত্রী ছাড়া। সে ধ্বংসপ্রাপ্তদের দলভুক্ত থাকবে। আমরা এ জনপদের অধিবাসীদের ওপর আকাশ থেকে আযাব নাযিল করবো তাদের পাপাচারের কারণে। আমি বুদ্ধিমান লোকদের জন্য এতে একটি স্পষ্ট নিদর্শন রেখে দিয়েছি।

(আরবী***********)

আমি মাদইয়ানবাসীদের প্রতি তাদের ভাই শু’আইবকে পাঠিয়েছিলাম। সে বললো: হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, শেষ দিবসের আশা রাখ এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। কিন্তু তারা তাকে মিথ্যেবাদী বললো। অতপর তারা ভুমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হলো এবং নিজেদের গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। (আনকাবুত: ৩৬-৩৭)

(আরবী***********)

আমি আ’দ ও সামুদ জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের বাড়িঘর দেখেই তাদের অবস্থা তোমাদের জানা হয়ে গেছে। শয়তান তাদের কর্মকে তাদের নিকট আকর্ষণীয় করে তুলেছিল এবং তাদেরকে সৎপথ অবলম্বনে বাধা দিয়েছিল, তারা ছিল হুশিয়ার। আমি কারূন, ফিরাউন ও হামানকে ধ্বংস করে দিয়েছি। মূসা তাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে আগমন করেছিল কিন্তু তারা দম্ভ-অহংকারে লিপ্ত ছিল, তাই বলে তারা জিতে যায় নি। আমি প্রত্যেককেই তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কারো কাছে পাঠিয়েছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড বাতাস, কাউকে পেয়েছে বজ্রপাত, কাউকে আমি বিলীন করেছি ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছি নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুমকারী ছিলেন না। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল। (সূরা আনকাবুত: ৩৮-৪০)

৭. সুসংবাদ ও সতর্কীকরণের সত্যতা: আল-কুরআনে ঘটনাবলী বর্ণনার আরেকটি কারণ হচ্ছে- ঈমানদারকে জান্নাত ও তার নিয়ামতসমূহের সুসংবাদ ও তার সত্যতার প্রমাণ করা এবং অবিশ্বাসীদের জন্য জাহান্নাম ও তার দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে সতর্ক করা এবং তার সত্যতা প্রমাণ করা। যেমন-

বলা হয়েছে:

(আরবী***********) (হে নবী!) তুমি আমার বান্দাদের জানিয়ে দাও, আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল-দয়ালূ। আর আমার শাস্তি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। (সূরা আল-হিজর: ৪৯-৫০)

এ আয়াতের পরপরই ক্ষমা ও শাস্তির সত্যতা সংক্রান্ত ও ঘটনাটি বলা হয়েছে:

(আরবী***********)

তুমি তাদেরকে ইবরাহীমের মেহমানদের অবস্থা বানিয়ে দাও। যখন তারা তার বাড়িতে আগমন করলো এবং বললো: সালাম। সে বললো: আমরা তোমাদের ব্যাপারে ভীত। তারা বললো: ভয় করবেন না। আমরা আপনাকে একজন জ্ঞানবান ছেলের সুসংবাদ দিচ্ছি। (হিজর: ৫১-৫৩)

তারপরই আল্লাহর রহমতের ফাল্গুধারা প্রকাশিত হচ্ছে:

(আরবী***********)

অতপর যখন প্রেরিতরা লূতের গৃহে পৌছল, সে বললো: তোমরা তো অপরিচিত লোক। তারা বললো: না বরং আমরা আপনার কাছে ঐ বস্তু নিয়ে এসেছি যে সম্পর্কে তারা বিবাদ করতো। আমরা আপনার নিক সত্য বিষয় নিয়ে এসেছি এবং আমরা সত্রবাদী। অতএব আপনি শেষ রাতে পরিবারের সকলকে নিয়ে চলে যাবেন এবং আপনি তাদের পশ্চাদনুসরণ করবেন না। আর আপনাদের মধ্যে কেউ যেন পেছন ফিরে না দেখে। আপনারা যেখানে যাবার নির্দেশ পেয়েছেন সেখানে যাবেন। আমি লূতকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেই যে, সকাল হলেই তাদেরকে সমূলে বিনাশ করে দেয়া হবে। (সূরা আল-হিজর: ৬১-৬৬)

উল্লেখিত আয়াতে হযরত লূত (আ)-এর ওপর রহম এবং তাঁর জাতিরকে ধ্বংস করে দেয়ার ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। একটু সামনে অগ্রসর হয়ে এ সূরায়ই বলা হয়েছে:

(আরবী***********)

নিশ্চয়ই হিজরের বাসিন্দারা পয়গম্বরগণের প্রতি মিথ্যারোপ করেছে। আমি তাদেরাকে নিজের নিদর্শনাবলী দিয়েছি কিন্তু তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তারা পাহাড়ে নিশ্চিন্তে ঘর খোদাই করতো। অতপর একদিন সকাল বেলা তাদেরকে একটি শব্দ এসে আঘাত করলো, তখন কোন উপকারেই এল না, যা তারা উপার্জন করেছিল। (সূরা হিজর: ৮০-৮৪)

এসব আয়অতে মিথ্যাবাদীদেরকে যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেয়া হয়েছে তা প্রকাশ করা হয়েছে। আল্লাহর ওয়াদা সঠিক ও কার্যকরী তাও প্রমাণ করে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ ঘটনাগুলো সেভাবেই উপস্থাপন করা হয়েছে যেবাবে তা সংঘটিত হয়েছে।

৮. নবী-রাসূলদের প্রদত্ত নিয়ামতসমূহের বর্ণনা: নবী ও রাসূলদের ওপার যেসব অনুগ্রহ ও নিয়ামত প্রদান করা হয়েছে তা বর্ণনার জন্যও আল-কুরআনে কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। যেমন হযরত দাউদ (আ), হযরত সুলাইমান (আ), হযরত আইউব (আ), হযরত ইবরাহীম (আ), মারইয়াম ও হযরত ঈসা (আ)-এর ঘটনাবলী। এ সমস্ত কাহিনী আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় এ সূরায় আলোচিত হয়েছে। প্রথম লক্ষ্য নিয়ামত ও অনুগ্রহের বর্ণনা দেয়া, সেই সাথে অবশ্য তাদের কিচু কার্যাবলীর বর্ণনাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে এসেছে।

৯. আদম সন্তানকে শয়তানের শত্রুতা থেকে সতর্ক করা: কুরআন মজীদে যেসব কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে- হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত যতো লোক পৃথিবীতে এসেছে এবং আসবে শয়তান তাদের প্রত্যেকের শত্রু, এ কথাটি বুঝিয়ে দেয়া। প্রতিটি মুহূর্তে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। কস্মিনকালেও সে মানুষের মঙ্গল চায় না। তারই জ্বলন্ত প্রমাণ হিসেবে হযরত আদম (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় শয়তানের অপতৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

১০. অন্যান্য আরও কতিপয় কারণ: আল-কুরআনে উপরোক্ত কারণ ছাড়াও নিম্নোক্ত কতিপয় কারণে বিভিন্ন ঘটনাবলী ও কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। যথা:

[১০.১] আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ- যেমন আদম ও ঈসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা, হযরত ইবরাহীম (আ) ও পাখির ঘটনা, ঐ ব্যক্তির ঘটনা [হযরত উযাইর (আ)] যে মরার একশ’ বছর পর জীবিত হয়েছিলেন। এ রকম আরও কিছু ঘটনাবলী।

[১০.২] ভাল ও কল্যাণকর কাজ এবং খারাপ ও অকল্যাণকর কাজের পরিণতি বর্ণনা, যেমন- আদম (আ)-এর দুই ছেলের ঘটনা, দুই বাগান মালিকের ঘটনা, বনী ইসরাঈলের ঘটনা, আসহাবে উখদুদের ঘটনা ইত্যাদি।

[০১.৩] মানুষের স্বভাব তাড়াহুড়া করা এবং তাড়াতাড়ি পাবার প্রচেষ্টা। এজন্য সে যা নগদ পায় অথবা যার বাস্তবতা আছে তার জন্য প্রচেষ্টা করে। অথচ আল্লাহ তাদেরকে প্রকৃত কল্যাণের জন্য অপেক্ষা ও ধৈর্যের গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এজন্য মানুষের তাড়াহুড়া ও আল্লাহর ধীর-স্থিরতার পরিণতি সম্পর্কেও কুরআনে বিভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- হযরত মূসা (আ) ও আল্লাহর এক বান্দর (খাজা খিযিরের) ঘটনা। যে সম্পর্কে আমরা সামনে আলোচনা করবো। এ ধরনের বিষয়বস্তুর ওপর আল-কুরআন অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছে। যা তার উদ্দেশ্যকে পূর্ণতায় পৌঁছে দিয়েছে।