রাসূল (সা)-এর প্রতি ভালোবাসা
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন দুনিয়ার সেরা মানুষ। তাঁর কথা, কাজ, আচরণ, ব্যবহার সবই ছিল অতুলনীয়। তাঁর অনুপম চরিত্রমাধুর্য সবাইকে মুগ্ধ করত। তাঁকে ভালোবেসে কত মানষের মন যে বিগলিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মহানবী (সা)-কে কাছে পেয়ে অনেকে তাঁর জন্য জীবনে উৎসর্গ করেছে। অনেকের কাছে প্রিয় নবীর সান্নিধ্য মা-বাবার আদরের চেয়েও তুচ্ছ মনে হয়েছে। তাদেরই একজন জায়েদ (রা)। পিতার নাম হারেসা। তিনি বিশ্বাসে ছিলেন খ্রিষ্টান।
হযরত যায়েদ তখন খুব ছোট। চাঁদের মতো ফুটফুটে শিশু যায়েদ। মায়ের কলিজার টুকরো এ শিশু। জায়েদকে মা বুকে জড়িয়ে রাখেন। সোনামণিকে আদর করে মায়েরা যেমন প্রাণ জুড়ান, জায়েদের মায়ের অবস্থাও সে রকমই। কিন্তু জায়েদকে বেশি দিন আদর করার ভাগ্য মায়ের হয়ে ওঠেনি।
একদিন মা আদরের সন্তানকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছিলেন। আরব দেশের মরুময় পথ। সে জামানায় মরুপথে যাতায়াত ছিল সীমাহীন কষ্টকর। তখন সূর্যের প্রচণ্ড তাপ মাথায় নিয়ে চলতে হতো। তা ছাড়া ডাকাতের উপদ্রব তো ছিলই। ডাকাতরা মরুভূমির ফাঁক-ফোকরে ওঁৎ পেতে বসে থাকত। সুযোগ পেলেই এরা অকস্মাৎ পথচারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং লোকজনের সর্বস্ব লুট করে নিত। অনেক সময় ডাকাতরা লোকজনকে বন্দী করে নিয়ে যেত। এসব বন্দীকে তারা ক্রীতদাস হিসেবে হাট-বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দিন।
জায়েধ ও তাঁর মায়ের ভাগ্যও ঘটল একই ঘটনা। তারা ডাকাতের হাতে পড়লেন। তস্কররা তাদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেল। ছোট বালক জায়েদসহ অনেককে ডাকাতরা বন্দী করল। একদিন জায়েদকে বিক্রি করে দেয়া হলো। এ সুযোগে হাকিম নামে এক লোক জায়েদকে কিনে নিল।
হাকিম ছিলেন হযরত খাদিজা (রা)-এর আপনজন। হাকিমের খালা তিনি। হাকিম জায়েদকে এনে খালা খাদিজার হাতে সমর্পণ করলেন। খাদিজা (রা) ছিলেন আরবের সেরা ধনী মহিলা। তাই তাঁর ঘরে অনেক দাস-দাসী কাজ করত। আরও কাজের লোচ চাই তাঁর। তাই জায়েদকেও তিনি কাজের জন্য রেখে দিলেন। খাদিজার ঘরে বালক জায়েদ বড় হতে লাগলেন। জায়েদ ছিলেন খুব বিশ্বস্ত ও কর্মঠ।
চল্লিশ বছর বয়সে হযরত খাদিজার সাথে মহানবী (সা)-এর বিয়ে হলো। এবার হযরত খাদিজা বালক জায়েদকে স্বামীর খেদমতে নিয়োগ করলেন। মহানবী (সা)-এর সান্নিধ্য পেয়ে জায়েদ তো মহাখুশী। আল্লাহর নবী সাথে থাকা যে বড় ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্যবান না হলে কেউ আল্লাহর নবীর এ কাছের জন হতে পারত না। খাদিজা (রা) যেমন জায়েদকে ভালোবাসতেন, তেমনি মহানব (সা)ও তাঁকে আদর করতেন।
ছোটবেলা থেকে জায়েধ মা-বাবার তেমন একটা আদর পাননি। তাতে কী? তিনি হযরত খাদিজার কাছে মায়ের চেয়েও বেশী আদর পেয়েছেন। আর এখন মহানবী (সা)-এর কাছে পেলেন বাবার আদর। ফলে তাঁর আনন্দ ও সুখ আর কে দেখে? এমনি করে জায়েদের নিগুলো সুখে-আনন্দে ভালই কাটছিল। মহানবী (সা)-এর খেদমত আর ইসলামের কাজ ছাড়া তাঁর কোনো ভাবনা নেই। নেই কোনো পিছুটানও।
তবে একদিন ঘটল এক ঘটনা। একদল হজযাত্রী কাবাঘর জেয়ারত করতে মক্কায় এলো। তাদের সাথে হযরত জায়েদের দেখা হলে যাত্রীদের একজন হযরত জায়েদকে চিনে ফেলল। সে নিশ্চিত হলো, এই বালকই হারেসার হারানো পুত্র জায়েদ। তাই তারা বিষয়টি হারেসাকে জানাবে বলে ভাবল। হজ সেরে লোকেরা বাড়িতে ফিরে হারেসাকে ঠিকই সবকথা খুলে বলল। প্রাণপ্রিয় পুত্র জায়েদের খবর শুনে বাবা হারেসার বুক খুশীতে লাফিয়ে উঠল। তাই কালবিলম্ব না করে সে তড়িঘড়ি করে মক্কায় হাজির হলো। জায়েধ হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সাথে থাকেন। তাই হারেসা সোজা মহানবী (সা)-এর বাড়ীতে গিয়ে উঠল।
মহানবী (সা)-এর বাড়িতে গিয়ে হারেসা ঠিকই জায়েদকে দেখতে পেল। অনেকদিন পর প্রাণাধিক পুত্রের মুখ দেখে হারেসার চোখ বেয়ে নেমে এলো আনন্দ অশ্রু। সে মহানবী (সা)-কে বলল,
: দেখুন নবীজি! জায়েদ আমার ছেলে, বুকের ধন, ও আমার হারিয়ে যাওয়া মানিক। আমি ওকে নিতে এসেছি। জায়েদকে দয়া করে ফিরিয়ে দিন। এ জন্য যা মূল্য চান আমি তা দিতে প্রস্তুত আছি। আপনি তো মহামানব। তাই না করবেন না। আমার ছেলে আমাকে ফিরিয়ে দিন।
মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর নবী। মানবতার দিশারি তিনি। মানুষের কল্যাণে তাঁর প্রাণ ছিল অবারিত, উদার। তিনি মানুষের প্রভু হতে আসেননি, এসেছেন মানুষের বন্ধু হয়ে। মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তির সওগাত নিয়ে তিনি দুনিয়ায় এসেছেন। তিনি দয়া, মায়া, মমতা ও মানবতার অগ্রদূত। মা-বাবার কাছে সন্তানের যে মূল্য তা তিনি সম্যক অনুধাবন করতে পারেন। তাই জায়েদের পিতা হারেসার দুঃখ তিনি বোঝেন। জায়েদের জন্য কী মুক্তিপণ নেবেন মহানবী (সা)! বরং তিনিই তো মানুষকে তাঁর সর্বস্ব বিলিয়ে দেন।
এ ক্ষেত্রেও মানবতার দিশারি তার প্রমাণ দিলেন। জায়েদ তাঁর সেবক। শুধু সেবক বললে ভুল হবে। তিনি আল্লাহর নবী (সা)-এর খুবই প্রিয়জন। তারপরও মহানবী (সা) নিজের কথা ভাবলেন না। জায়েদকে তিনি সাহিমুখে হারেসার হাতে তুলে দিলেন। হারেসা তো হতবাক। এত সহজে ছেলেকে ফিরে পাবেন, তা ছিল হারেসার কল্পনারও বাইরে। মহানবী (সা)-এর উদারতা দেখে হারেসা আবেগে –কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হলো। তার খুশি আর কে দেখে? কারও হারানো পুত্র ফিরে পাবার আনন্দ ও তৃপ্তি যে কত মধুর তা ঐ মা-বাবা ছাড়া আর কারো অনুধাবন করাও কঠিন। আজ হারেসার মনের অবস্থাও তাই। পুত্র জায়েদকে পেয়ে হারেসার বুক ভরে গেল। সে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো।
এমন সময় ঘটল উলটো এক ঘটনা। জায়েধ এতক্ষণ ধরে সবই শুনছিল। এবার সে বেঁকে বসল। তার এক কথা, রাসুল (সা)-কে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। জায়েদ বলল: আমি আমার বাবা ও মাকে পেয়ে গেছি। নবীজি আমার বাবা, খাদিজা (রা) আমার মা। তাঁরাই আমাকে সত্যিকারের আদর করেছেন। আমি বাবা-মাকে ছেড়ে কোথাও কারও কাছে যাব না।
বাবা হারেসা জায়েদের অনড় অবস্থা দেখে হতাশ হলেন। পুত্রকে অনেক করে বুঝালেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। এতে জায়েদের মন গলল না। অগত্যা সুখে মহানবী (সা)-এর সেবা করে যেতে লাগলেন। এভাবেই জায়েদ আজীবন মুহাম্মদ (সা)-এর কাছে থেকে গেলেন।
দেখতে দেখতে জায়েদ বড় হলেন। বিয়ে শাদির সময় হলে নবীজির আপন চাচাতো বোন জয়নাবের সাথে তাঁর বিয়ে দেয়া হলো। ফলে নবী পরিবারে সাথে জায়েদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলো। জায়েদের এক ছেলে সন্তান ছিল। নাম উসামা। নবীজি তাকে বড্ড বেশি আদর করতেন। নবীজি তাঁর প্রিয় নাতি হাসান-হোসেনের মতোই উসামাকে ভালোবাসতেন।
মক্কা বিজয়ের দিনের ঘটনা। মহানবী (সা) উটে চড়ে মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর সাথে উটের পিঠে বসেছিলেন উসামা। তা থেকেই বোঝা যায়, উসামা মহানবী (সা)-এর কত কাছের জন ছিলেন। মহানবী (সা)-এর গভীর ভালোবাসা পেয়ে জায়েদ বাবা-মাকে পর্যন্ত ভুলে যেতে পেরেছেন। মহানবী (সা)-এর ভালোবাসার কাছে জায়েদের সবই ছিল তুচ্ছ। জায়েদের কাছে মহানবী (সা) ছিলেন এক পরশ পাথর। তাঁর জাদুকরী ছোঁয়ায় জীবন বদলে গিয়েছিল জায়েদের। এভাবে আরও কত লাখো কোটি মানুষের জীবনকে আল্লাহর নবী (সা)-এর আদর্শ বদলে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই!
ব ল তে পা রো?
১। জায়েদ কে ছিলেন? তাঁর পিতার নাম কী?
২। একদিন বেড়াতে গিয়ে জায়েদের ভাগ্যে কী ঘটল?
৩। জায়েদের খবর কারা তার বাবাকে জানাল?
৪। জায়েদের পিতা মহানবী (সা)-কে গিয়ে কী বলেছিল?
হযরত খাব্বাব (রা)-এর অনন্য জীবন
মক্কার কাফের মুশরেকরা ছিল প্রবল ক্ষমতাধর। তারা ছিল প্রচণ্ড ইসলামবিরোধী। কাফেরেদে বেশির ভাগই ছিল ভয়ানক প্রকৃতির লোক। একেবারে ক্ষ্যাপা হায়েনার মতো ভয়ানক। উম্মে আনমার তাদেরই একজন। সে ছিল ব্যবসায়ী। দাস বেচা-কেনা ছিল তার পেশা। দাসরাও তো অন্যদের মতোই মানুষ ছিল। তবুও তখনকার দিনে বাজার নিয়ে দাসদের কেনা-বেচা করা হতো। মানুষকে মানুষ বেচত, কেউবা তাকে কিনত। এরকম কাজ যে কতটা অমানবিক ছিল তা কল্পনা করাও কঠিন। তবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর মুহাম্মদ (সা) এ অপমানজনক পেশার অবসান ঘটালেন।
উম্মে আনমার দাস বেচাকেনা করলে কী হবে? তার নিজের জন্যও এটা দাসের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তাই সে একজন বলিষ্ঠ ও ছটপটে দাস খুঁজছিল। দাস কেনার জন্য আনমার একদিন বাজারে গেল। শত শত দাস উঠেছে বাজারে। এদের মধ্যে একজনকে আনমারের খুব পছন্দ হলো। দাসটি ছিল বেশ জোয়ান ও শক্ত-সমর্থ। দাসটির নাম খাব্বাব। তাকে বেশ ভদ্র ও বুদ্ধিমদান বলে মনে হচ্ছিল। তাই দাসটিকে পেয়ে আনমার যারপরনাই খুশি হলো। বিক্রেতার দাবি মিটিয়ে আনমার খাব্বাবকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। সে দাসটিকে তরবারি তৈরির কলাকৌশল শেখানোর পরিকল্পনা নিল। তাই তাকে মক্কায় একজন কর্মকারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো। খাব্বাব ছিলেন বেশ বুদ্ধিমান। তাই তিনি অল্পদিনের মধ্যেই তরবারি বানানো শিখে ফেললেন। হযরত খাব্বাবের বুদ্ধিমত্তা ও গুণের কারণে আনমার যারপরনাই খুশি হলো। দাসটির সাহস, যোগ্যতা ও ন্যায়নিষ্ঠা আনমারকে বিস্মিত করল।
তখন ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগ। ইসলামের দাওয়াত প্রচারের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। মহানবী (সা) অতি গোপনে দীনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা তাঁর সাথী হয়েছেন তাঁরাও অতি সাবধানে মানুষকে দীনের দাওয়াত দিচ্ছেন। ইসলাম প্রচারের এ খবর হযরত খাব্বাবের কানে এসে পৌঁছল। আর যায় কোথায়? তাঁর মন ছিল সত্যের প্রতি অনুরাগী। তাই হযরত খাব্বাব (রা) আর বসে থাকতে পারলেন না। তিনি চুপি চুপি মহানবী (সা)-এর কাছে গিয়ে তাঁর মনের বাসনা খুলে বললেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন।
ইসলাম কবুল করার ফলে বদলে গেল হযরত খাব্বাবের জীবন। দীনের পরশ তাঁকে সত্যের প্রতি আরও বেশি আকুল করে তুলল। খোদায়ী দীনের স্পর্শ পেয়ে তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। এখন তাঁর একটাই ভাবনা। আল্লাহর কথা কিভাবে প্রচার করা যায়। কিভাবে ইসলামের আলো পথহারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। তিনি কামারশালায় কাজ করেন। আর ফাঁকে ফাঁকে শুধু আল্লাহর চিন্তায় মগ্ন থাকেন।
খাব্বাব (রা) নিজে থেকে না বললেও তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর চাপা থাকল না। বাতাসের বেগে তা মক্কার সবখানে ছড়িয়ে পড়ল। এ খবর মনিব আনমারের কানেও গেল। দাস ইসলাম কবল করেছে! আনমারের মাথায় আগুন ধরে গেল। তাই ইসলামবিরোধী আনমার বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল।
ক্ষণিকের মধ্যেই আনমার তার দলবলসহ কামারশালায় গিয়ে হাজির হলো। সেখানে পেয়ে গেল খাব্বাবকে। আর যায় কোথায়? প্রচণ্ড রাগ ও উত্তেজনায় কাঁপছে আনমার। সে হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
: তুই না কি মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছিস, বল, জবাব দে?
: হ্যাঁ করেছি, জবাব দিলেন খাব্বাব।
এমনিতেই আনামর ছিল বেশ উত্তেজিত। মুখের ওপর খাব্বাবের জবাব শুনে সে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো রেগে গেল। আনমার রাগতস্বরে বলল,
: তোর এত বড় সাহস? আমার কেনা গোলাম হয়ে তুই আমার ধর্ম ত্যাগ করেছিস? তুই নাস্তিক হয়ে গেছিস? বলতে বলতে খাব্বাবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আনমার। তার দলের লোকেরা কামারশালার হাতুড়ি ও লোহার পাত দিয়ে হযরত খাব্বাবকে পেটাতে লাগল। গায়ে যত শক্তি ছিল তা দিয়ে খাব্বাব (রা)-কে এলোপাতাড়ি মারতে লাগল।
ফলে আঘাতের পর আঘাতে খাব্বাবের দেহ ক্ষতবিক্ষত হলো। তাঁর শরীরের চামড়া ছিঁড়ে গেল। মাথা কেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল। টাটকা খুন ঝরতে জরতে খাব্বাবের দেহ প্রায় অবশ হয়ে পড়ল। অত লোকের শত আঘাত তিনি আর সইতে পারছিলেন না। ফলে একসময় জ্ঞান হারালেন। সেদিন তো এভঅবেই কেটে গেল। মারের এই ধাক্কা সামলাতে তাঁকে যে কী কষ্ট পেতে হয়েছে তা বর্ণনা করাও কঠিন। তারপর থেকে আরও বহুবার খাব্বাবকে অনেক জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। মার খেয়েছেন, জীবনেরও হুকমি এসেছে। তারপরও হযরত খাব্বাব (রা) দীনের স্পর্শ ত্যাগ করেননি।
অনেক সময় মনিবের লোকেরা তাঁকে পশুর মতো করে টেনে-হিঁচড়ে মরুভূমিতে নিয়ে যেত। ভর দুপুরে মরুভূমি আগুনের ফুলকি ছড়াত। আর এ সময় দুশমনরা হযরত খাব্বাবকে তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে রাখত।
কখনও তাঁর শরীরে লোহর বর্ম পরানো হতো। ফলে তিনি নড়াচড়া করতে পারতেন না। মাঝে মাঝে ফুটন্ত বালুতে উপুড় করে শুইয়ে খাব্বাবকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ফেলে রাখা হতো। ফলে গরমে তাঁর চামড়া পুড়ে যেত। অনেক সময় গরমে ঘাম ঝরতে ঝরতে খাব্বাব (রা) অবশ হয়ে যেতেন। তখন তৃষ্ণায় তাঁর বুক ফেটে যেতে চাইত। তিনি পানি চেয়ে চিৎকার করতেন। এতে কাফেররা কুশি হতো। তারা হায়েনার মতো কপট হাসি হেসে খাব্বাবকে উপহাস করত। এক ফোঁটা পানি তো দিতই না, বরং তারা খাব্বাবকে উদ্দেশ্য করে বলত,
: বোঝ মজা। মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করার শাস্তি বোঝ। এবার মাথা ঠিক হয়েছে তো? তা হলে ইসলাম ত্যাগ কর। নতুন ধর্ম ত্যাগ করলে তোকে ছেড়ে দেব। পানি, খাবার সবই পাবে। শুধু বল, আমি মুহাম্মদের ধর্ম ছেড়ে দিলাম।
হযরত খাব্বাব (রা) দুশমনদের কথা শুনে আরও দৃঢ় হন। তাঁর মুখে তখন জোরে জোরে ধ্বনিত হতো মহান আল্লাহর নাম। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে একসময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন। তারপর আবারও জ্ঞান ফিরে এলে আল্লাহকেই ডাকতে থাকতেন।
হযরত খাব্বাবের ওপর দিনের পর দিন ধরে চলত এ ধরনের নির্যাতন। উম্মে আনমারের বদমেজাজিও অত্যাচারী এক ভাই ছিল। সে ছিল আরও নিষ্ঠুর। সে প্রতিদিন খাব্বাবের কামারশালায় যেত। এসেই উত্তপ্ত লোহার পাত তুলে চেপে ধরত খাব্বাবের মাথায়। এতে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে খাব্বাবের জ্ঞান হারিয়ে যেত। হুঁশ ফিরে এলে তাঁকে আবারও নির্যাতন করা হতো। তারপরও তিনি দমে যাননি। কোনো অত্যাচারকেই খাব্বাব পরোয়া করতেন না।
হযরত খাব্বাব ছিলেন অতিশয় দরিদ্র। তবে তাঁর মন ছিল সত্যের সম্পদ ও সৌন্দর্যে ভরপর। তিনি ছিলেন পাহাড়ের মতো দৃঢ়চেতা ও অনড়। মহান আল্লাহকে ভালবেসে তিনি আরও ইস্পাত কঠিন হয়ে ওঠেন।
তিনি একাই কাফের কুরাইশতের সাথে লড়াই করেছেন। তাদের অন্যায় ও অসত্য অহমিকাবোধকে রুখে দাঁড়িয়েছেন। কাফেরদের শত নিপীড়নের মুখেও মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে তিনি মাথা নত করেননি, সত্যের পথ থেকে একচুলও নড়েননি। হযরত খাব্বাব (রা) আমাদের জন্য তাই অনন্য আদর্শ হয়ে আছেন।
ব ল তে পা রো?
১। উম্মে আনমার কে? সে কিসের ব্যবসা করত?
২। হযরত খাব্বাবকে কে কিনে নিল? তাঁকে কী কাজ শেখানো হলো?
৩। ইসলাম গ্রহণ করলে খাব্বাব (রা)-এর ওপর কিরূপ নির্যাতন নেমে এলো?
৪। খাব্বাব (রা)-কে মরুভূমিতে নিয়ে কিভাবে নির্যাতন করা হতো?
৫। খাব্ববা (রা)-এর আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল?
দুরন্ত সাহসী সেনাপতি হযরত খালিদ (রা)
এক, ইসলামের আলো মক্কার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ছিল। মানুষ দলে দলে এসে ইসলামের পতাকাতলে জমায়েত হচ্ছিল। সুদূর মদীনায় পৌঁছে গেল দীনের আলো। আল্লাহর সত্য বাণী দ্রুত উদ্ভাসিত হতে লাগল। ফলে মিথ্যায় ঢাকা অন্ধকারের চাদর সরে যেতে লাগল। এক নতুন প্রভাবের আগমনী বার্তা যেন শোনা যাচ্ছিল সর্বত্র। সবখানে ধ্বনিত হচ্ছিল ইসলামের জয়গান। মানুষের মুখে মুখে নবী মুহাম্মদ (সা)-এর নাম আলোচিত হচ্ছিল। হযরত খালিদ (রা) ছিলেন একজন বীর সেনানী। তিনি তখনও ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নেননি। মুসলমানেরদ জানের দুশমন এই খালিদ। ভয়ানক শত্রু বলে মুসলমানরা তাকে চেনে। ইসলামকে ধাবিয়ে রাখতে তিনি কম কষ্ট করেননি।
তবে সত্যের বিরুদ্ধে আর পেরে উঠতে পারছিলেন না। সারাক্ষণ তাঁর বিবেক ইসলামের আবেশে নাড়া খাচ্ছিল। মনের দরজায় উঁকিবুকি দিচ্ছিল দীনের আলোর সুষমা। ধীরে ধীরে তিনি সত্যের আবেশে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হলেন। তাই তিনি গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন। এদিকে ইসলামের বিরুদ্ধেও তিনি খুব পরিচিত নাম। সবাই তাকে লিডার হিসেবে মানে। এটাও যে অনেক বড় মর্যাদা। কিন্তু এটা তো মিথ্যার পথ। মিথ্যাকে আর মেনে নিতে তাঁর বিবেক চাইল না। এদিকে সমাজের পাপ-পঙ্কিলতা তার মনকে বিষিয়ে তুলল। তাই তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। না, এভাবে আর চলা যায় না। অসত্যের জীবন আর নয়। খালিদ শেষমেশ নড়ে চড়ে উঠলেন। ইসলামকে কবুল করতে তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়লেন। একসময় মহানবী (সা)-এর সান্নিধ্য পেতে খালিদের মধ্যে পেরেশানি সৃষ্টি হলো।
একদিন তিনি মদীনার পথে পা বাড়ালেন। মদীনা তখন অনেক দূরের পথ। তাতে কী? নবীজির সাথে তাঁকে দেখা করতেই হবে। অবশেষে খালিদ ঠিকই মদীনায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং নবীজির সাথে দেখা করলেন। কালবিলম্ব না করে মহানবী (সা)-এর হাতে হাত রেখে খালিদ ইসলাম কবুল করে নিলেন।
হযরত খালিদ (রা) ইসলামে দাখিল হওয়ার আগে নবীজিকে বললেন,
: হে দীনের নবী (সা)! আমি জীবনের অনেক অন্যায় করেছি। আমার অনেক অপরাধ হয়েছে। এতদিন ভুল পথে চলে জীবনকে কালিমালিপ্ত করেছি। আমি নিজের ওপরও অনেক জুলুম করেছি। আজ আমি সত্য ও মিথ্যার তফাত বুঝতে পেরেছি। আর না বুঝে ইসলামেরও অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। মুসলমানের মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আজ আপনি আমাকে মাফ করে দিন। এখনই আমাকে সত্য দীন গ্রহণ করার সুযোগ দিন।
খালিদ এতদিন ছিলেন ইসলামের পরম শত্রু। দীনের আলো নির্বাপণে যার হাত ছিল সক্রিয়, সেই খালিদ এখন ইসলামের মহান সেবকে পরিণত হলেন। তার মতো একজন বীর পুরুষের ইসলাম গ্রহণে মুসলমানদের শক্তি আরও বেড়ে গেল। এদিকে মহাবীর খালিদের জন্য শুরু হলো আরেক ভিন্ন জীবন। এ জীবন সুন্দর ও সৌরভে ভরা, এ জীবন বেহেশতী আলোয় উদ্ভাসিত। দীন কায়েমের দীর্ঘ সংগ্রামে খালিদ (রা) শামিল হলেন। ফলে কাফেররা আঁতকে উঠল। মুশরেকদের হৃদকম্পন শুরু হলো। হযরত খালিদের যে তরবারি ইসলামের ধ্বংসে ব্যবহৃত হতো, তা এখন দীন কায়েমের লড়াইয়ে শতগুণ দৃঢ়তায় গর্জে উঠল। তাঁর ক্ষুরধার তরবারির সামনে দাঁড়াতে কাফেররা আর সাহস পেল না। কাফেররা জানে খালিদের বীরত্ব কতটা ভয়ানক ও সুকঠিন। ইসলামে আসার পর তাঁর তরবারি বহু মুশরেক ও কাফেরের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করেছে, তাদের প্রচণ্ড তছতছ করে দিয়েছে।
দুই, ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খালিদ (র) প্রথম মুতার জেহাদে অংশ নিলেন। সেই যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব সবাইকে অবাক করে দিল। একে একে তিনজন মুসলিম সেমানপতি সেদিন শহীদ হলেন। এতে মুসলিম সেনারা হতবিহবল হয়ে পড়লেন। তারা সবাই ঘাবড়ে গেলেন। চরম পরাজয়ের অন্ধকার সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। কিন্তু নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন হযরত খালিদ। সাহসিকতার সাথে তিনি সেনাপতির দায়িত্ব নিলেন। এরপর খালিদের সুনিপুণ নেতৃত্বে মুসলমানরা শত্রু সেনাদের ওপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তাঁর যুদ্ধ পরিচালনায় শত্রু শিবিরে নেমে এলো অমানিশা। ফলে শত্রুরা দিকশূন্য হয়ে পড়ল। যুদ্ধ করতে করতে একে একে খালিদের সাতটি তরবারি ভেঙে গেল। তারপরও থামলেন না তিনি। প্রাণপণে লড়াই করে অগণিত শত্রু খতম করলেন খালিদ (রা)। হযরত খালিদ (রা)-এর বুদ্ধি, অপরাজেয় সাহস ও অমিত বীরত্বের কাছে হেরে গেল কাফের মুশরেক দল। মুতায় নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে রেহাই পেল মুসলিম বাহিনী।
তিন, হুনাইনের জেহাদে হযরত খালিদের বীরত্বও ছিল প্রশংসনীয়। তিনি অসীম সাহসিকতার সাথে হুনাইনে লড়াই করেন। শত্রুদের তীরের আঘাতে তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। সেই ক্ষত দিয়ে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরে পড়ল। তবু থেকে যাননি হযরত খালিদ (রা)। হুনাইনের ময়দানে তাঁর তরবারির ধার এতটুকুও কমেনি, বরং তিনি দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে মুসলিম শিবিরে সাহসের দোলা জাগান। এখানেও শত্রুরা পরাজিত হয়।
চার, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মক্কা অভিযানে হযরত খালিদ (রা) ছিলেন সক্রিয়। বিনা প্রতিরোধে মক্কা বিজিত হলেও সেদিন সামান্য রক্ত ঝরেছিল। আবু জেহেলের ছেলে মুসলমানদের অবস্থা বুঝে উঠতে পারেনি। তাই সে সামান্য প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল। তার লোকেরা হযরত খালিদকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করেছিল। এর জবাবে খালিদের তীর শত্রুদের দিকে ধাবিক হলো। বিদীর্ণ হলো শত্রুদের বুক। সেখানেই মারা পড়ল কয়েকজন মুশরেক। আর ব্যর্থ হলো তাদের প্রতিরোধ।
পাঁচ, মহানবী (সা)-এর ওফাতের পরের ঘটনা। হযরত আবু বকর (রা) ভণ্ডনবী তুলাইহাকে দমন করার জন্য হযরত খালিদকে দায়িত্ব দিলেন। খালিত তাঁর বাহিনী নিয়ে তুলাইহাকে শায়েস্তা করতে বের হলেন। তুলাইহার বাহিনীর সাথে তুমুল লড়াই হলো। জেহাদে তুলাইহা চরমভাবে পরাজিত হলো। সেদিন আরও অনেকে হযরত খালিদের বাহিনীর কাছে খতম হলো। তুলাইহার ত্রিশজন সেনাকে খালিদের লোকেরা বন্দী করল। তাদের এনে হাজির করা হলো হযরত আবু বকর (রা)-এর সামনে।
ছয়, এরপর হযরত আবু বকর (রা) ভণ্ডনবী মুসাইলামা কাজ্জাবের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করেন। এবারও সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হলো হযরত খালিদকে। তাঁর বীরত্বে মুসাইলামার বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হলো। হযরতওয়াহিশীর হাতে নিহত হলো মুসাইলামা। এই মুসাইলামাই ছিল নবীজির চাচা হযরত হামজার হন্তা। ভণ্ড নবীদের পরাভূত করে এবার খালিদ (রা) মুরতাদদের নির্মূলে অভিযানে নামলেন। তাদেরও দৃঢ়তার সাথে পরাজিত করলেন তিনি। জাকাত অস্বীকারকারী মুনাফেকরাও হযরত খালিদের তরবারিরর কাছে পরাজিত হলো। তিনি প্রতিটি জেহাদে অত্যন্ত সফল হলেন। এরপর হযরত খালিদ ইরাকে অনেক লড়াই পরিচালনা করেন। তাতেও খালিদের অতুলনীয় সফলতা আসে। হযরত খালিদ (রা)-এর সাহস ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে একসময় সমগ্র ইরাক মুসলমানদের করতলগত হলো।
সাত, ফাহলের যুদ্ধে রোমান শত্রুরা হযরত খালিদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করল। তবে তাদের জেহাদ থামল না। রোমানরা এবার দামেস্ক আক্রমণ করে বসল। প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছিল মুসলিম বাহিনীর সাথে। হযরত খালিদ (রা) অসীম সাহস ও যোগ্যতার সাথে যুদ্ধ পরিচালন করলেন। রোমান বাহিনী হযরত খালিদের নেতৃত্বে একসময় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাদের বহু সেনা সেদিন নিতহ হলো, আহত হলো অসংখ্য শত্রুসেনা। অহঙ্কারী রোমান সম্রাট ও পরাজয় মেনে নিতে পারল না। তাই তারা আবারও যুদ্ধের জন্য তৈরি হলো। এবার বিপুল রণসম্ভার ও সৈন্য নিয়ে রোমানরা প্রস্তুতি নিলো। রোমান সেনাপতির নাম মাহান। তিনি দু’লাখ চব্বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ইয়ারমুক ময়দানে সমবেত হলেন।
রোমানদের যুদ্ধ যাত্রার খবর পেয়ে হযরত আবু বকর (রা)ও বসে থাকরেন না। তিনি মহাবীর হযরত খালিদকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন ইয়ারমুকে। ৫০,০০০ সেনার এক বিশাল মুসলিম বাহিনী। ইয়ারমুকে এসে হযরত খালিদ প্রতিপক্ষ সেনাপতি মাহানের সামনাসামনি হলেন। কিন্তু রোমান সেনাপতি মাহান বুঝতে পারল, এই যুদ্ধে তারা জয়ী হতে পারবে না। তাই চতুর রোমান সেনাপতি মুসলমানদের সাথে সমঝোতার চিন্তা করলেন। হযরত খালিদের সাথে রোমান সেনাপতি মাহান কথা বললেন। মাহান প্রস্তাব করলেন,
: শোন খালিদ! তোমাদের অনেক অভাব। তোমরা অনেক দূর থেকে এসেছ। তোমার সেনারা ক্ষুধার্ত। তাই বলি, আমার আপস প্রস্তাব মেনে নাও। তুমি রাজি হলে তোমাদের প্রত্যেককে দশটি দিনার করে দেব, এক প্রস্থ কাপড় দেব। তোমাদের খাবারও দেব। আগামী বছরও তোমরা এভাবে জিনিসপত্র পাবে। এসব কিছুর জন্য শর্ত হলো, তোমরা যুদ্ধ না করে এখান থেকে চলে যাবে।
মাহানের এ প্রস্তাবে হযরত খালিদ অপমানবোধ করলেন। তিনি রোমান সেনাপতিকে বললেন,
: মাহান! তুমি জান, মুসলমানরা ভিখেরির জাত নয়। তারা আল্লাহর সৈনিক। অর্থের বিনিময়ে তাদের কেনা যায় না। একথা বলেই হযরত খালিদ ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন। তারপর সোজা ছুটলেন তাঁর সেনা ছাউনির দিকে। মুসলিম সেনারা ছিল প্রস্তুত। খালিদ ‘আল্লাহু আকবার’ বলে জেহাদের ঘোষণা দিলেন। আর অমনি তিনি বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন রোমান বাহিনীর সামনে। মহানবীর খালিদ প্রথমেই ঢুকে পড়লেন রোমান অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী ঠিক মাঝখানে। তারপর তীব্রভাবে চলালেন তরবারি। যারাই সামনে এলো তারাই হযরত খালিদের ক্ষুরধার তরবারিরর নিচে পড়ে মারা পড়ল।
মুসলিম সেনারা সবাই প্রাণপণে লড়াই করলেন। মুসলমানদের বীরত্ব হযরত খালিদের সুনিপুণ নেতৃত্ব রোমান বাহিনীকে দিশেহারা করে তুলল। তারা আর টিকে থাকতে পারল না।
পরদিন সকাল বেলা। রোমান বাহিনীর একেবারে তছনছ অবস্থা। তাদের অসংখ্য লাশে ভরা ইয়ারমুক ময়দান। আহত হয়ে যারা বেঁচে গেছে তারা ছাউনিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে হযরত খালিদকে দেখা গেল তিনি রোমান সেনাপতি মাহানের মঞ্চের ওপর বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছেন। এ কাণ্ড দেখে রোমানরা আঁতকে উঠল। মুসলিমদ সেনারাও হতবাক হলো। হযরত খালিদের বীরত্ব ও সাহসিকতায় সবাই চমকে গেল। সেদিন রোমানদের আরেক কমাণ্ডার ছিলেন জারজাহ। তিনি হযরত খালিদের অসীম সাহস, দৃঢ় নেতৃত্ব ও খোদাভীতি দেখে বিস্মিত হলেন। আর তখনই তিনি ইসলাম কবুল করে নিলেন এবং রোমানদের পক্ষ ছেড়ে মুসলিম ছাউনিতে এসে আশ্রয় নিলেন।
এভাবে হযরত খালিদ (রা) তাঁর দায়িত্ব নিবিড়ভাবে পালন করেছেন। তাঁর সাহস, নেতৃত্ব, দায়িত্ববোধ ও বীরত্ব ইসলামের সুমহান আদর্শকে অনেক ওপরে তুলে ধরেছিল। ইসলামের শক্তি হযরত খালিদের যোগ্য নেতৃত্বে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। হযরত খালিদ (রা) সকল জেহাদে অসীম বীরত্ব ও সাহসকিতার পরিচয় দিয়েছেন। যুদ্ধ করকে করতে খালিদ (রা) তাঁর জীবনের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে তাঁর শরীরের প্রতিটি জায়গায় তীর কিংবা বর্শার চিহ্ন দেখা যেত।
ইসলামের ইতিহাসে মহাবীর খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ এক অনন্য নাম। মহানবী (সা) হযরত খালিদকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বলতেন,
: তোমরা খালদকে কষ্ট দিও না। কেননা, সে কাফেরদের বিরুদ্ধে চালিত আল্লাহর তরবারি আর তখন থেকেই খালদের উপাধি হয়েছিল ‘সাইফুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর তরবারি’। এ উপাধি নবী (সা) একজনকেই দিয়েছিলেন। সেই সৌভাগ্যবান সাহাবী আমাদের প্রিয় বীর হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা)।
হযরত খালিদ (রা)-এর মৃত্যুর পর হযরত উমর (রা) দুঃখ করে বলতেন, ‘আমাদের নারীরা খালিদের মতো সন্তান প্রসবে অক্ষম হয়ে গেছে, সত্যিই হযরত খালিদের মতো এমন মহান বীর ইসলামের ইতিহাসে তেমনটি আর দেখা যায়নি’।
ব ল তে পা রো?
১। হযরত খালিদ কে ছিলেন?
২। ইসলামে দাখিল হবার আগে খালিদ মহানবী (সা)-কে কী বলেছিলেন?
৩। ইয়ারমুক যুদ্ধে রোমান সেনাপতি কে ছিলেন?
৪। ইয়ারমুক জেহাদে রোমান ও মুসলিম সৈন্যসংখ্যা কত ছিল?
৫। রোমান সেনাপতি হযরত খালিদকে কী প্রস্তাব দিলেন?
৬। কোন রোমন কমাণ্ডার কেন এবং কিভাবে ইসলাম কবুল করলেন?
৭। মহানবী (সা) হযরত খালিদকে কী উপাধিতে ভূষিত করেন?